(ভুয়া সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বাড়ছে। তারা বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রিকার জাল পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় করে। এতে বিপাকে পড়ছেন পেশাদার সাংবাদিকরা। অশিক্ষিত অযোগ্য কথিত সাংবাদিকরা জাতীয় পত্রিকাকে স্থানীয় পত্রিকা বলে অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করে হুংকার ছাড়ে আমার বিরুদ্ধে লিখে দেন,আমি যে খারাপ তা সবাই জানে। হাটে হাড়ি ভাঙ্গলে আমার কিছু হবে না, কারণ আমি নির্লজ্জ-বেহায়া- ভাবটা এমনি অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না, অল্প বিদ্যা ভয়ংকর।)
আব্দুল্লাহ্ আল মামুন :
একজন খ্যাতিমান সাংবাদিকের বক্তব্যের একটি লাইন আমার হৃদস্পন্দনে বার বার প্রতিবিম্বিত হচ্ছে এখনও। লাইনটি হচ্ছে ‘হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দিলাম, জানিনা বাড়ী ফিরতে পারবো কি না। আমিও এই লেখাটির মাধ্যমে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয়ে আজ হাটে হাড়ি ভেঙে দিলাম এটা জেনেও যে, এর মাধ্যমে অনেক তথাকথিত সাংবাদিকদের বিরাগভাজন হতে হবে হয়তো আজীবনের জন্য। তাছাড়া সম্পাদকদের সিংহভাগই লেখাটি তাদের পত্র পত্রিকায় ছাঁপানো দূরের কথা, পরে রাগ গোস্বা অভিমান করতে পারেন আমি অধমের উপর।
তবুও বিবেকের তাড়নায় কলম না ধরে উপায় ছিলোনা। কয়েক দশক যাবত সাংবাদিকতা এবং লেখালেখির জগতে বিচরণ করে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি তার মধ্যে কোনটা রেখে কোনটা লেখি তা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে আমাকে। আজ সাংবাদিকদের মধ্যে বিভেদ পেশাদার সাংবাদিক আর অপেশাদার সাংবাদিকের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। একদল সত্যের পক্ষে। আরেক দল যা খুশি করার পক্ষে। একদল চাচ্ছেন পেশার মর্যাদা রক্ষা করতে, অন্যদলের চিন্তাভাবনার সময় নেই।
দিন দিন বিভক্তি বাড়ছে। লেজুড়বৃত্তি করতে না পারলে অনেকের ‘ঘুম’ হয় না। সাংবাদিকদের প্রকারভেদ ঘটছে। গ্রুপিং হচ্ছে শাখা প্রশাখার মতো। অনেকে আবার সাংঘাতিক, কখনো হলুদ সাংবাদিক, আন্ডারগ্রাউন্ড সাংবাদিক, চাঁদাবাজ সাংবাদিক, সন্ত্রাসী সাংবাদিক, এমএলএম সাংবাদিক আবার কখনো এমনি এমনি সাংবাদিক, কখনো শখের সাংবাদিক, কাঁচিওয়ালা সাংবাদিক, সিন্ডিকেট সাংবাদিক, কপি সাংবাদিক, বিজ্ঞাপন সাংবাদিক, রাজনৈতিক সাংবাদিক, গলাবাজ সাংবাদিক, ভাড়াটে সাংবাদিক, দালাল সাংবাদিক, ঠিকাদার সাংবাদিক, নামধারী কার্ড ধারী সাংবাদিক, ফেসবুক সাংবাদিক প্রভৃতি বলা হয় তাদের।
বিভিন্ন বিশেষনে ভূষিত করা হলেও তারা সাংবাদিক এটাই বড় কথা। এ নিয়ে কারো খারাপ লাগা বা মনে সামান্য দুঃখবোধও জাগে না। যদিও মানুষ মাপার মেশিন নাই, তথাপিও প্রতিনিধি নিয়োগ দেবার সময় শিক্ষাগত যোগ্যতা পাঠশালা পাশ কি না, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায় কোন দিন গিয়েছে কি না, শুদ্ধভাবে একটি সংবাদ লেখা দুরের কথা তিন দিনের ছুটি চেয়ে প্রধান শিক্ষকের নিকট একটি ছুটির দরখাস্ত লিখতে পারবে কি না তা বাছবিচার না করেই প্রতিনিধি নিয়োগ প্রদান করেন অধিকাংশ তথাকথিত সম্পাদক বা তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা। কোথাও কোথাও দেখা যায় ইতিপুর্বে বিভিন্ন ধরনের যেমন রিকসা ভ্যান, ঠেলা, ভটভটি, করিমন, নছিমন, ইমা, লেগুনা, বাস, ট্রাক বা রাইসমিলের ড্রাইভার, হেল্পার, রাজ ও কাট রং মি¯ুÍরি, যোগালি, ধুপা, নাপিত, মুছি, দালাল, টাউট, চোরাকারবারী, পতিতা, হকার, আদম ব্যাপারী, হুন্ডি ব্যবসায়ী ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত ছিল বা আছে কিন্তু পরবর্তীতে সময় সুযোগমতো এরাও সাংবাদিকের খাতায় নাম লেখাতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি।
আমাদের সাবেক প্রয়াত এক মন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সম্মানজনক সকল পেশায় লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমেই শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি যাচাই বাছাই করা হলেও আমাদের দেশে ঐ একটি পেশায় শিক্ষাগত যোগ্যতার কোন দরকার পড়েনা। সেই মহান পেশাটি হচ্ছে সাংবাদিকতা! ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠিস্বার্থ চরিতার্থ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার হচ্ছে।
ঐসব সাংবাদিক এখন হলুদ সাংবাদিক’নামে পরিচিত। আমাদের দেশে জাতীয় স্থানীয় দৈনিক সাপ্তাহিক পাক্ষিক মাসিক ত্রৈমাসিক অনেকগুলি পত্র-পত্রিকা সুনামের সাথে হচ্ছে প্রকাশিত। সাংবাদিকতা একটা ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু সম্মানের পেশা। হামলা মামলা হতে পারে যেকোন সময়। হচ্ছেও তাই। সৎ সাংবাদিকদের উপরই মূলত হামলা মামলা হয় বেশি। বর্তমান সময়ে সৎ সাংবাদিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে এই কঠিন মুহূর্তেও নবীন প্রবীণ অনেক সৎ সাংবাদিক ভাইয়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে শক্ত হাতে কলম চালিয়ে যাচ্ছেন দুর্নীতিবাজ ধান্দাবাজ চাটুকার ও লুটেরা ও হায় হায় কোম্পানীর বিরুদ্ধে।
বিনিময়ে পাচ্ছেন বিবেকবানদের দোয়া ও ভালোবাসা। মরণের পরও মানুষ যুগ যুগ ধরে তাদের স্মরণ করবে তাদের কর্মের জন্য। বেড়ায় যদি ধান খায় তাহলেতো এই বেড়া আরও বিপজ্জনক। সর্ষের মধ্যে যদি ভুতের অবাধ বিচরণ থাকে তাহলে ভুত তাড়াবেন কি দিয়ে? কথিত ভুয়া সাংবাদিকে ভরে গেছে রাজধানী বা এর আশে পাশে” রাজধানীর উপকুলে অথবা রাজধানীর ভিতরে সাংবাদিকের অভাব নেই। একজন সাংবাদিকের কাছে দেখা যায় প্রায় ডজন খানেক পত্রিকার পরিচয়পত্র আইডি কার্ড।
দামি বেশভূষা, হাতে ক্যামেরা, বাহন হিসেবে মোটর সাইকেল বা প্রাইভেট কার, কোমরে/গলায় কিংবা পকেটে ঝোলানো যেন তেন পত্রিকা বা অনলাইন নিউজ পোর্টালের পরিচয় পত্র কিংবা টাকা দিয়ে কেনা কোন নামিদামী ইলেকট্রিক মিডিয়ার আইডি কার্ডধারী অশিক্ষিত নামদারী সাংবাদিক দেখে বোঝার উপায় নেই এরা প্রতারক বা চাঁদাবাজ। এরা সরাসরি প্রবেশ করছে সরকারি দপ্তরে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে পড়ছে। থানায় যাচ্ছে, দালালি করছে। আর প্রশাসনও সাংবাদিক ভেবে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। ব্যবসায়ী মহলকে বিপাকে ফেলে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
এদের হাতে প্রতিনিয়ত অপমান ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। শিক্ষক, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী কেউ বাদ পড়ছে না এ প্রতারক চক্রের চাঁদাবাজির হাত থেকে। সম্প্রতি সময়ে এদের অপকর্ম মহামারী আকারে ধারণ করেছে। আর সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় দাগী সন্ত্রাসী, চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, তালিকাভুক্ত অস্ত্র ব্যবসায়ীরাও এসকল পত্রিকা ও নিউজ পোর্টালের কার্ড ঝুলিয়ে নিজেদের সাংবাদিক দাবি করছে। ফলে আতংক ছড়িয়ে পড়ছে রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে। কেবল তাই নয়, এসকল ভুয়া সাংবাদিক ও সাইনবোর্ড সর্বস্ব মানবাধিকার কর্মীদের তালিকায় খুনি, ধর্ষক ও চাঁদাবাজরাও রয়েছে। যাদের নামে বিভিন্ন থানায় হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজী, বোমাবাজী, অস্ত্র কারবারি বা মাদক ব্যবসায়ীর একাধিক মামলা রয়েছে, তাদের হাতে সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র দেখে রীতিমত থমকে যাচ্ছে সচেতন মহল।
সচেতন মহল প্রশ্ন তুলেছেন, এসকল ভুঁইফোড় পত্রিকা কিভাবে বাজারে আসে? বা এই সকল নাম সর্বস্ব নিউজপোর্টাল ও সাইনবোর্ড সর্বস্ব মানবাধিকার সংগঠনগুলো কিভাবে বছরের পর বছর টিকে থাকে? তারা প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাসহ সংশি¬ষ্ট মন্ত্রণালয়ের আশু হস্তক্ষেপ দাবি করে এসকল প্রতিষ্ঠানের মালিক বা সম্পাদক নামধারীদের আইনের আওতায় আনার জোর দাবি তুলেছেন। দুর্নীতির এক অন্ধকারজগতে বসবাস করছে সাংবাদিক নামদারী কিছু লোক। তারা সাংবাদিকতার পরিচয় ভাঙ্গিয়ে সমাজে বারোটা বাজিয়ে যাচ্ছে। এদেরকে বলা হয় হলুদ সাংবাদিক’ এদের সংখ্যা বাড়ছে। আগে সাংবাদিকদের মানুষ শ্রদ্ধা করতো, ভালোবাসতো আপনজন হিসেবে জানতো। এখন তাদেরকে ভয় পায় না এমন কেউ নাই। ঠেকলে কাছে আসতে চায় না, এজন্য হয়তো কেউ কেউ সাংবাদিকদের সাংবাদিক এর বদলে সাংঘাতিক সম্বোধন করে।
এমন অনেক সাংবাদিক আছেন-যাদের কাগজ কলম কিনতে হয় না বছরে একটি নিউজ পাঠাতে হয় না। মিডিয়ার সঙ্গে কোন যোগাযোগের দরকারও নেই। তবে সাংবাদিক হিসাবে পরিচয়পত্র আছে, সাংবাদিক তালিকায় তাদের নাম আছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাংবাদিক হিসাবে দাওয়াত করা হয় আর কি চাই, এরা হচ্ছেন এমনি এমনি সাংবাদিক। কিছু কিছু পত্রিকা আছে যার সাংবাদিকদের লেখা লিখির কোন কাজ নেই। একটি কাঁচি থাকলেই যথেষ্ট। পুরানো পত্রিকা থেকে দু -চারটি সংবাদ (নিউজ ভ্যালু থাকার দরকার নেই) কাচি দিয়ে কেটে কম্পোজম্যান/কম্পিউটারম্যানের কাছে পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত তার কর্ম। এজন্য দিনে সর্বোচ্চ ঘন্টাখানেক সময় দিলেই চলে। কিছু সাংবাদিক আছেন সারাদিন ঘুরে বেড়ান,নিউজের কাছেও যান না বিকালে সহকর্মীদের কাছে এসে বলেন -কি আছে দেও তারপর সেই বন্ধুর নিউজের কপি মেইলে পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দেয়া, এই তার সারা দিনের কাজ।
আবার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মতো সাংবাদিকদের ও সিন্ডিকেট আছে। সবার পক্ষ হয়ে একজন সাংবাদিক নিউজ লেখেন, ঐ নিউজের বেশ কয়েকটি কপি করা হয়। এরপর তিনি বিভিন্ন সাংবাদিকের ঠিকানায় ই-মেইলে তা পাঠিয়ে দেন। অন্য সাংবাদিকের খোজ খবর নেয়ার ও দরকার হয় না। শুধু মিডিয়ায় পাঠিয়ে দেয়াই তার কাজ। অনেক সময় তাও করতে হয় না। আগের ব্যক্তিই সব কাজ করে দেন। জোটবদ্ধ এই সাংবাদিকের নাম দেয়া হয়েছে সিন্ডিকেট সাংবাদিক।
অনেক সাংবাদিক আছেন যাদের নিউজ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই সারা দিন সরকারি বেসরকারি অফিসে ধর্ণা দেয়া, কর্মকর্তা কর্মচারীদের পান সিগারেট খাওয়ানো মাঝে মাঝে হলুদ খাম (সরাসরি দিলেও খতি নেই) আবার কারো কারো চার পাঁচটি পত্রিকার কার্ড রয়েছে।
এখন অশিক্ষিত সাংবাদিকদের মিছিল বাড়ছে। কোনটা বাংলা দৈনিকের, কোনটা ইংরেজি দৈনিকের (ই’ না জানলেও ইংরেজি পত্রিকার সাংবাদিক ) রিপোর্ট করা থেকে নিবৃত্ত করার জন্য নিলামের মতো দর ওঠে। আর টাকা দেয়া না হলে, খেয়াল খুশি মতো নিউজ ছাপা হবে, প্রয়োজনে সিরিজ নিউজ, নিউজ আইটেম না হলেও নিউজ। টাকায় নাকি ভিটামিন আছে, তাই টাকা নিতে ওই সাংবাদিকদের কোন লজ্জা নাই। ভুয়া সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বাড়ছে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রিকার জাল পরিচয়পত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন পেশার মানুষকে হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় করে। এতে বিপাকে পড়ছেন পেশাদার সাংবাদিকরা।
আমাদের দেশে ভালো সাংবাদিকের অভাব নেই তারা সমাজের মঙ্গলের কথা চিন্তা করেন দেশের কথা ভাবেন নিজের দায়বদ্ধতা, পেশার মান সম্মান সব দিক তার নজরে থাকে কিন্তু কে ভালো কে মন্দ তা বিচার করার সময় সাধারণ মানুষের নাই। তারা সবাইকে এক পাল্লায় মাপেন এজন্যই আজকাল অনেকেই নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিতে চান না। অনেকটা গোপনে কাজ করতে চায়। সাংবাদিকতার মতো একটি মহান পেশার এই চিত্র কারো কাম্য হতে পারে না।
সচেতন মহল অবশ্যই চান -এ পেশা থেকে সব আবর্জনা দূর হোক নতুন সমাজ গড়তে সাংবাদিকের কলম আরও শক্তিশালী হোক পেশার মর্যাদা বৃদ্ধি পাক, বন্ধু হিসেবে সব সময় সাংবাদিক থাকবে সাধারণ মানুষের পাশে, সে সোজা পথে চলবে। ঐসব অলিগলিতে পা দিয়ার চিন্তাও তার মাথায় আসবে না। আসলে সাংবাদিকতার এ খন্ডচিত্র স্থায়ী হতে পারে না। মেঘের পরেই সূর্য, সাংবাদিকতার সূর্যালোকে আলোকিত হোক এ দেশের প্রতিটি জনপদ।
এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়
Leave a Reply