(প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও অনুপ্রবেশকারীদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। অথচ এই অনুপ্রবেশকারীদের কারণে ত্যাগীরা বঞ্চিত-নিপীড়িত; তাদের মুখে শুধুই হতাশার সুর। বিভিন্ন কমিটিতে এক শ্রেণির নেতারা দুর্নীতি-অনিয়মে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ; তাই দেখে নিবেদিতপ্রাণ নেতারা প্রতিবাদ করতে গিয়ে হচ্ছেন নির্যাতিত।)
শের ই গুলঃ
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাফল্য ও গৌরব ম্লান করে চলেছে দলের অভ্যন্তরে উড়ে এসে জুড়ে বসা হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারী গোষ্ঠী। এদেরকে দলের নেতাকর্মীরা বিষফোঁড়া বলেই মনে করছেন। টানা এক যুগের মতো দলটি ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, সুবিধাবাদী, আওয়ামী লীগের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ব্যাপক সংখ্যক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নাম লিখিয়েছে। নাম লিখিয়েই তারা ক্ষান্ত নয়, দলের নানা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে চলেছে এবং বাগিয়ে নিচ্ছে নানা অনৈতিক সুবিধা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা ১৪ বছর সরকার পরিচালিত হচ্ছে। বিরোধীদল সরকারের বিরুদ্ধে বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলেও স্বাধীনতাবিরোধী ও ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রকারীরা হাত গুটিয়ে বসে নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারি বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা পরিকল্পিতভাবে নিয়মিত আওয়ামী লীগে যোগদান করছেন। ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে, অনুপ্রবেশকারীরা খুবই সূক্ষ্ম কৌশল অবলম্বন করে তৃণমূল পর্যায়ে যেমন ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা কমিটি গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সন্তুষ্ট করে কমিটির গুরুত্বহীন পদ-পদবি ম্যানেজ করে আওয়ামী লীগার সাজেন।
পরবর্তী সময়ে খুবই ধীর গতিতে এগোতে থাকেন। ঐ নেতাদের ছবির সঙ্গে নিজের ছবি সংযুক্ত করে ফেস্টুন-ব্যানার লাগিয়ে আত্মপ্রচার শুরু করেন। পরবর্তী পর্যায়ে আরও ওপরের পর্যায়ের নেতাদের ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে ভূরিভোজ করিয়ে ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে সন্তুষ্ট করেন। পরে স্থানীয় থানা বা জেলা পর্যায়ের নেতাদের অবগত না করে, তাদের অনুমতি ছাড়াই ঐ সব কেন্দ্রীয় বড় বড় নেতাদের অতিথি করে ব্যক্তিগত প্রচারের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা বড় নেতাদের সম্মানে ঐ সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে অনুপ্রবেশকারীদের আত্মপ্রচারকে বৈধতা দিতে বাধ্য হন। এমনিভাবে সুযোগসন্ধানী বর্ণচোরা নব্য আওয়ামী লীগাররা সংগঠনে প্রভাবশালী হয়ে উঠছেন। রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় গঠিত শান্তি কমিটির প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এমন ব্যক্তি ও তাদের সন্তান-স্বজনদের কেউ কেউ নানা কৌশলে ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোতে ঢুকে পড়েছেন। তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, দল ক্ষমতায় আসার পর থেকে ত্যাগের মূল্যায়ন পাচ্ছেন না দুর্দিনের নেতারা।
অন্যদিকে দলে অনুপ্রবেশকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। সারা দেশে দলের একটি বড় অংশ বঞ্চিত। দলের একশ্রেণির প্রভাবশালী নেতাদের ব্যক্তিগত বলয়ের কারণে তারা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। বিরোধী মতাদর্শী, বর্ণচোরা অনুপ্রবেশকারীরা তৃণমূল আওয়ামী লীগের জন্য শঙ্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৌশলে দায়িত্বপ্রাপ্ত একশ্রেণির নেতাদের ম্যানেজ করে ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিও বাগিয়ে নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। তাদের দাপট আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতায় তারা পরিপুষ্ট। অনুপ্রবেশকারীদের ভিড়ে অনেকটা কোণঠাসা ত্যাগী নেতাকর্মীরা। কৌশলে প্রভাবশালী হয়ে প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন। অথচ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই বলে আসছেন, ‘বিভিন্ন সংকটে দলের বড় নেতারা সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলেও তৃণমূল সব সময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তৃণমূলই দলের প্রাণ, মূল শক্তি। সেই তৃণমূল আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের টার্গেট করছে স্বাধীনতা ও আওয়ামীবিরোধী চিন্তাধারার ব্যক্তিরা। তারা দলে ভিড়ে ত্যাগী নেতাদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করছে।
তৃণমূল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যারা নিবেদিতপ্রাণ বলে পরিচিত ছিলেন, দলের দুর্দিনে যারা ত্যাগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন, আজ তারাই নিপতিত হয়েছেন চরম দুর্দিনে। ক্ষমতাবান, সুবিধাভোগী আর স্বার্থবাজ নেতারা তাদের দূরে ঠেলে রেখেছেন। দলীয় কর্মকাণ্ডেও অংশ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না তারা। প্রভাবশালী নেতাদের চারপাশে এখন সুযোগসন্ধানী অনুপ্রবেশকারী নেতাদেরই ভিড়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পরীক্ষিত ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করার জন্য একাধিক বার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ত্যাগীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে এমন শত শত অভিযোগ জমা পড়েছে ধানমন্ডিস্থ দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে। আওয়ামী লীগের আওয়ামী লীগ নামধারী এ গোষ্ঠীটির কারণে উপমহাদেশের প্রাচীনতম এ দলটির সুনাম, ঐতিহ্য ও মর্যাদা ধসে পড়ছে বলে মনে করছেন নানা পর্যায়ের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। দল ও সরকারে কৌশলে অনুপ্রবেশ করে এসব অশুভ শক্তি এখন এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে এদের দাপটে দুর্দিনের ও দুঃসময়ের নেতাকর্মীরা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সময় কেন্দ্র হতে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উঠলেও তাকার্যকর হতে দেখা যায়নি। মূলতঃ ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটে দলটিতে। এ সময় কেন্দ্রীয় ও জেলা, উপজেলা পর্যায়ের নেতারা নিজেদের স্বার্থে, দল ভারি করার উদ্দেশে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি এমনকি বঙ্গবন্ধুর খুনির দল ফ্রিডম পার্টির নেতাদেরও নিজ দলে ঠাঁই দেন। দলের দুঃসময়ে যারা এগিয়ে আসেন, তাদের কেন মূল্যায়ন হয় না এখন এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি ও ১৫ আগস্টের খুনিদের দোসররা এখনো ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে।’ সম্প্রতি একাধিক দলের ঘরোয়া বৈঠকেও তিনি একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তার পরও অনুপ্রবেশকারীদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। অথচ এই অনুপ্রবেশকারীদের কারণে ত্যাগীরা বঞ্চিত-নিপীড়িত; তাদের মুখে শুধুই হতাশার সুর। বিভিন্ন কমিটিতে এক শ্রেণির নেতারা দুর্নীতি-অনিয়মে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ; তাই দেখে নিবেদিতপ্রাণ নেতারা প্রতিবাদ করতে গিয়ে হচ্ছেন নির্যাতিত। তাদের অনেকে ক্ষোভে-দুঃখে দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। এই অবস্থা আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোতেও চলছে।
এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে প্রকৃত আওয়ামীলীগের কর্মী খুজে পাওয়া যাবেনা। নাম না জানাতে ইচ্ছুক আওয়ামী লীগের ২০ জন ত্যাগী নেতাকর্মী প্রাণের বাংলাদেশকে জানান, বাংলাদেশ থেকে যারা বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিল, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনে বাধা দিয়েছে, তাদের আওয়ামী লীগে রাখার যৌক্তিকতা কী? তারা আরও বলেন, আওয়ামী লীগের পদ-পদবি পেতে অর্থ বিনিয়োগকারী এবং অর্থ বিনিয়োগে সহায়তাকারী নেতাদেরও চিহ্নিত করা প্রয়োজন। অনতিবিলম্বে যদি আওয়ামী লীগের এই অনুপ্রবেশকারীদের দাপট ঠেকানো না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের জন্য অশনিসংকেত তৈরি হবে।
এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়
Leave a Reply