শনিবার, ২৫ মার্চ ২০২৩, ০২:১৬ অপরাহ্ন

উত্তরার ‘গ্যাং’ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে ৫০টিরও বেশি অপরাধ চক্র

Reporter Name
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
  • ৩১ Time View

 

 

 

শের ই গুল :

 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত ও বিশেষ অভিযানে কিছু অপরাধী ও ছিঁচকে সন্ত্রাসী ধরা পড়লেও কমছে না অপরাধের মাত্রা। জামিনে মুক্ত হয়ে অনেকে ফের অপরাধে জড়াচ্ছে। বিদেশে পলাতক এবং কারাবন্দি অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী এখনো অপরাধ জগতের কলকাঠি নাড়ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের ৫০টি থানা রয়েছে- যা ক্রাইম ডিভিশন হিসেবে ৮ ভাগে বিভক্ত। রাজধানীর বিস্তৃত এলাকাজুড়ে অপরাধের ধরন অভিন্ন হলেও এলাকাভিত্তিক অপরাধে আছে ভিন্নতা। রাজধানীর উত্তরা পূর্ব, উত্তরা পশ্চিম, দক্ষিণখান, উত্তরখান, তুরাগ ও বিমানবন্দর থানা নিয়ে উত্তরা বিভাগ গঠিত। রাজধানীর পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হিসেবে খ্যাত উত্তরায় আভিজাত্যের চাকচিক্য থাকলেও অপরাধীদের দৌরাত্ম্যে তা অনেকটাই বিবর্ণ। বিশেষ করে উঠতি বয়সী কিশোরদের কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটে নিচ্ছেন কিছু রাজনৈতিক নেতা। উল্টো যতই দিন গেছে, ততই বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য।

উত্তরা এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও খুন থেকে শুরু করে সবই করছে ৫০টির বেশি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, উত্তরা এলাকার আসল সম্রাট এখন ওই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরাই। প্রতি অলিগলিতে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য থাকায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। এই গ্যাং কালচার থেকে মুক্তি চাইছেন তারা। শুধু কিশোর গ্যাংই নয়, উত্তরা এলাকায় সক্রিয় রয়েছে মাদক ব্যবসায়ী, আবাসিক এলাকায় অনুমোদনহীন আবাসিক হোটেল বানিয়ে অবাধে চলছে দেহ ব্যবসা, চাকরি দেয়ার নামে বছরের পর বছর প্রতারণা করে যাচ্ছে বিভিন্ন নামধারী এমএলএম কোম্পানি, ক্লাবগুলোতেও চলছে অনৈতিক কার্যক্রম, ফুটপাত থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন প্রভাবশালী নেতা ও পুলিশের অসাধু কর্মকর্তারা, প্রভাব খাটিয়ে রাজউকের প্লট দখল করে ঘর-দোকান বানিয়ে ভাড়া দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতাচ্ছে একটি চক্র, অবৈধ ব্যটারিচালিত অটোরিকশা থেকে মাস ভিত্তিতে হাতানো হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

এছাড়া ডেভেলপার কোম্পানির নামে মানুষকে ফাঁদে ফেলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন চক্র। প্রাণের বাংলাদেশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, উত্তরার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছে ৫০টির মতো কিশোর গ্যাং। এসব গ্রুপে সক্রিয় পাঁচ শতাধিক কিশোর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন সেক্টর এলাকায়। কোনো কোনো গ্রুপে ৯০ থেকে ১০০ জন সদস্যও রয়েছে। উত্তরার কিশোর গ্যাং সম্রাটদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাকিবুল হাসান সানি, আক্তারুজ্জামান ছোটন, ইকবাল, মো. নাজমুল হুদা নাদিম, মো. বাহাউদ্দিন হাসান শাওন ওরফে গ্রিল শাওন ও কারাগারে থাকা বিশ্ব চন্দ্র শীল। গাজীপুরের গাছা থানার বাসিন্দা হলেও উত্তরা এলাকায় আক্তারুজ্জামান ছোটনের রয়েছে বিশাল গ্যাং।

মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও হত্যার ঘটনা হরহামেশাই ঘটাচ্ছে এ গ্যাংয়ের সদস্যরা। দক্ষিণখান ও উত্তরা পশ্চিম থানায় ছোটনের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা রয়েছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দক্ষিণখান ও উত্তরখানের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছে নাদিম ও তার কিশোর গ্যাং। নাদিমের বিরুদ্ধে এই দুই থানায় ছয়টি মামলা রয়েছে। উত্তরার বিভিন্ন এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছে গ্রিল শাওনের গ্যাং। তার বিরুদ্ধে উত্তরখান, দক্ষিণখান ও উত্তরা পশ্চিম থানায় আটটি মামলা রয়েছে। সাকিবুল হাসান সানির গ্যাংয়ে রয়েছে ৮০ থেকে ১০০ জন সদস্য। এই গ্যাংটি চাঁদাবাজি, মাদক সেবন, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের দলে ভেড়াতে প্রতিনিয়ত সক্রিয় রয়েছে। বর্তমানে কারাগারে থাকা বিশ্ব চন্দ্র শীলের গ্যাংয়ের ৬০ থেকে ৭০ জন সদস্য এখনো দক্ষিণখান এলাকায় সক্রিয় রয়েছে। তাদের মধ্যে নাঈম মিয়া, ইব্রাহিম, আসিফ মাহবুব, ফরহাদ হোসেন, বিজয়, শাওন হোসেন ও শুভ অন্যতম। এই গ্রুপের অনেক সদস্য উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে রাজউক অফিসের সামনেও নিয়মিত আড্ডায় মিলিত হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুলের সামনে আড্ডাবাজি ও মারামারিতে লিপ্ত হয়। উত্তরা পূর্ব থানা এলাকায় সক্রিয় রয়েছে আক্তারুজ্জামান ছোটনের গ্যাং।

এ গ্রুপের অন্যতম সদস্যরা হলো দুধ শামীম, উল্লাস, কনক ও মুসাডন। এছাড়া উত্তরা এলাকার ভয়ংকর কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে রয়েছে জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্ল্যাক রোজ, বিগ বস, পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, তালা চাবি গ্যাং, নাইন স্টার, নাইন এমএম বয়েজ, পোঁটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, এনএনএস, এফএইচবি, রনো, কে নাইন, ফিফটিন গ্যাং, থ্রি গোল গ্যাং, শাহীন রিপন গ্যাং, নাজিম উদ্দিন গ্যাং, ইকবাল গ্রুপ, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফানসহ নামে বেনামে বিভিন্ন গ্যাং। স্থানীয়রা বলছেন, রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় থাকায় উত্তরায় বন্ধ হচ্ছে না গ্যাং কালচার। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দক্ষিণখান থানাধীন আজমপুর কাঁচাবাজার সংলগ্ন হাসান কমপ্লেক্সের ৬ষ্ঠ তলায় (লিফটের-৫) সিঙ্গাপুর আবাসিক হোটেলে অনৈতিক কাজ চলছে বছরের পর বছর। একই ভবনের ৪র্থ তলায় রয়েছে বি এলার্ট সিকিউরিটি কোম্পানি নামে কোম্পানি। নামধারী প্রতিষ্ঠানটি চাকরি দেয়ার নামে প্রার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে আসছে। অভিযোগ রয়েছে সিঙ্গাপুর আবাসিক হোটেল থেকে মাসে ৩০ হাজার ও বি এলার্ট সিকিউরিটি কোম্পানি থেকে মাসে ৪০ হাজার টাকা দেয়া হয় থানা পুলিশকে। ফলে দিনের পর দিন অনৈতিক কাজ ও প্রতারণা করে এলেও এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডের ৪৬ নম্বর বাড়িতেও রয়েছে অনুমোদনহীন আবাসিক হোটেল। ৩ নং সেক্টরের হোটেল টোকিও প্যাসিফিক, ব্লু-বার্ড, এক্সপ্রেস মল, মনপুরা, মাঝেমধ্যে পুলিশ এসবে অভিযান চালালেও নাম পাল্টে দিব্বি চলছে অসামাজিক কার্যকলাপ। এছাড়াও উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের হোটেল অ্যারো লিংক, একই সেক্টরের ১২০ নম্বর রোডের বিন হাই ক্লাবে চলছে অনৈতিক কার্যক্রম। পাশাপাশি কসাইবাড়ি মোড়সহ হাজী ক্যাম্প, আশকোনা, কাওলা, উত্তরার বিভিন্ন এলাকায় অনুমোদনহীন আবাসিক হোটেল খুলে অসামাজিক কার্যকলাপ চলছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে রাজউকের কমার্শিয়াল জায়গায় অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা বিডিআর বাজার থেকে থানা পুলিশকে দেয়া হয় ৫০ হাজার টাকা, আবদুল্লাহপুর বেড়িবাঁধের ২৫০ দোকান থেকে সপ্তাহে চাঁদা তোলা হতো ৪০ হাজার টাকা, যা বর্তমানে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। আবার রাস্তার নিচে দোকান করা হয়েছে। কামারপাড়া কাঁচাবাজার থেকে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশের নামে চাঁদা দেয়া হয় ৫০ হাজার টাকা, ফার্নিচার মার্কেট থেকে পুলিশের নামে চাঁদা ওঠে ২ লাখ টাকা। হাউজবিল্ডিং-আজমপুর-রবীন্দ্রসরণী ও রাজলক্ষ্মীর সামনের ফুটপাত এবং এবি মার্কেটের পেছনের ফুটপাত থেকে চাঁদা ওঠে ৪-৫ লাখ টাকা। এই এলাকার চাঁদা ওঠানোর কাজ করেন পুলিশের সোর্স ও হাইব্রীড নেতারা।

এছাড়া উত্তরা এলাকায় থাকা তিনটি মদের বার থেকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা চাঁদা নেয় সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। কসাইবাড়ি থেকে কাঁচকুড়া ও হজ ক্যাম্প থেকে কাঁচকুড়া রোডে চলাচলকারী ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকেও নিয়মিত মাসোয়ারা নিচ্ছে থানা পুলিশ। উত্তরার বিভিন্ন সেক্টর এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে বিভিন্ন মাদক কারবারি। আবদুল্লাহপুরের সেলিনার বস্তিতে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে আলতাফ ওরফে ঠেঁঁঁাঁট কাটা আলতাফ, ফরিদ মার্কেট এলাকায় রতন, মুন্সি মার্কেট এলাকায় কাশেম, দেওয়ান ফরহাদ, মুক্তিযোদ্ধা রোড এবং আজমপুরে বাবু ও চাপাতি মাসুদ, এপিএস গার্মেন্টস এলাকায় নাসির, ফায়দাবাদের গোয়ালটেকে মশিউর মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের সঙ্গে সখ্য রয়েছে পুলিশ সদস্যদের।

মাদক ব্যবসা থেকে মাসোহারা নেয়ার পাশাপাশি ডিশ ব্যবসা থেকেও মোটা অঙ্কের মাসোহারা নেয় উত্তরা বিভাগের বিভিন্ন থানা পুলিশ বলে অভিযোগ আছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উত্তরার বিভিন্ন এলাকার ডিশ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করেন শাহজাহান ভান্ডারি। চৈতি গার্মেন্টস এলাকা শাহীন দেওয়ান, আজমপুর কাঁচাবাজার এলাকায় ডিশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন বিএনপি নেতা মামুন এবং ফায়দাবাদে নাজমুল ও মো. আলী। তারা প্রত্যেকই পুলিশকে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানি রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা ও থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে মানুষকে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। জানা গেছে, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও তুরাগ থানা এলাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ভেজাল কারখানাও। উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোর্শেদ আলম প্রাণের বাংলাদেশকে বলেন, উত্তরায় রাজধানীর অন্য এলাকা থেকে অপরাধ ততটা ভিন্ন নয়। দুয়েকটা ক্ষেত্রে একটু আলাদা। তবে সব ধরনের অপরাধ নির্মূলে পুলিশ সবসময় তৎপর।

কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে ডিসি বলেন, অল্প বয়সী কিশোররা যাতে সমাজের মাথাব্যথার কারণ না হয়ে ওঠে, সেদিকে বিশেষ নজর রাখা হয়। এরপরও কেউ অপরাধে জড়িয়ে গেলে আইনের আওতায় আনা হয়। বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে অভিযান চালানোর পরও কীভাবে দেহব্যবসা চলছে, জানতে চাইলে মোর্শেদ আলম বলেন, জনবল সংকটের কারণে অনেক ক্ষেত্রে নজরদারিতে রাখা সম্ভব হয় না।

এছাড়া নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে তথ্য পেলেই আমরা অভিযান চালাই। রাজউকের জমি দখল করে দোকান ও ঘর উঠিয়ে ব্যবসা করার বিষয়ে ডিসি বলেন, এটি পুলিশের দেখার কথা নয়। এটি রাজউকের বিষয়।

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়