এ্যাড. সাহারা খাতুন এমপি (ঢাকা-১৮):
অনেক শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পেয়েছি আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়াারি। মায়ের ভাষাকে রক্ষার জন্য রাজপথে আন্দোলন হয়। পাকিস্তানি সরকারি বাহিনীর গুলিতে প্রাণদান করে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। সালাম-বরকত-রফিক-শফিক-জব্বার আরও কত নাম না-জানা সেসব শহীদের আত্মত্যাগে আমরা ফিরে পাই আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা। জাতিসংঘের স্বীকৃতির ফলে একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে।
একুশে ফেব্রুয়াারি কী করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হলো সেই গল্পই তোমাদের জন্য আমাদের বাংলা ভাষার জন্য এক দারুণ ব্যাপার ঘটল সেদিন। দিনটি ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইউনেসকোর ৩০তম অধিবেশন বসে। ইউনেসকোর সেই সভায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব পাস হয়। ফলে পৃথিবীর সব ভাষাভাষীর কাছে একটি উল্লেখযোগ্য দিন হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি পায়। বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষা লাভ করে বিশেষ মর্যাদা। ঠিক পরের বছর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়াারি থেকে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশে এ দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়।
একুশে ফেব্রুয়াারি বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পেছনের ঘটনা জানতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। মহান ভাষা আন্দোলনের দিন হিসেবে একুশে ফেব্রুয়াারি প্রতিবছরই মর্যাদার সঙ্গে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে পালিত হয়ে আসছে। এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা রাজ্যে ‘বাংলা ভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে এই দিনটি।
২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করার আগে, দিনটি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দাবি শোনা যায়। তবে এ বিষয়ে প্রথম সফল উদ্যোক্তারা হলেন কানাডার বহুভাষিক ও বহুজাতিক মাতৃভাষা-প্রেমিকগোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী প্রথমে ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ নামে একটি দিবস ঘোষণার প্রস্তাব উপস্থাপন করে। সেখানে তাঁরা বলেন, বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সেটা ছিল তাদের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। কাজেই মাতৃভাষা দিবসের দাবিটি খুবই ন্যায়সংগত।মাতৃভাষা-প্রেমিকগোষ্ঠীর এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন সাত জাতি ও সাত ভাষার ১০ জন সদস্য।
জাতিসংঘ মহাসচিবের অফিস থেকে এই পত্রপ্রেরকদের জানিয়ে দেওয়া হয়; বিষয়টির জন্য নিউইয়র্কে নয়, যোগাযোগ করতে হবে প্যারিসে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ওসংস্কৃতিবিষয়ক সংগঠন ইউনেসকোর সঙ্গে। এরপর প্রায় এক বছর পেরিয়ে যায়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি ইউনেসকো। কানাডা প্রবাসী বাঙালি আবদুস সালাম ও রফিকুল ইসলাম (যাঁরা মাতৃভাষা-প্রেমিক গোষ্ঠীর সদস্য) এ বিষয়ে ইউনেসকোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেন। প্রথমে টেলিফোনে এবং পরে চিঠিতে। ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ ইউনেসকো সদর দপ্তরের ভাষা বিভাগের কর্মকর্তা আন্না মারিয়া একটি চিঠিতে রফিকুল ইসলামকে জানান, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার তোমাদের অনুরোধটি বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার একজন কর্মকর্তার কাছে এই প্রথম বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।
আন্না মারিয়া আরও জানান, বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে উত্থাপনের কোনো সুযোগ নেই, ইউনেসকোর পরিচালনা পর্ষদের কোনো সদস্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে সভায় এটি তুলে ধরা হবে।রফিকুল ইসলামকে ইউনেসকো পরিচালনা পর্ষদের কয়েকটি সদস্য দেশের ঠিকানাও পাঠিয়ে দেন মারিয়া। এতে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, কানাডা, ফিনল্যান্ড ও হাঙ্গেরির নাম ছিল।
ইউনেসকো সাধারণ পরিষদে বিষয়টি আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হলে কয়েকটি সদস্য দেশের পক্ষে প্রস্তাব পেশ করা জরুরি। তখন হাতে সময় ছিল খুবই কম। কেননা, অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সাধারণ পরিষদের সভা বসবে।কানাডা থেকে রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্য গর্বের বিষয় মনে করে মন্ত্রণালয় অতি দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর অফিসে অনুমতি চেয়ে নোট পাঠায়। বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সময়স্বল্পতার বিষয়টি উপলব্ধি করেন। তিনি সব ধরনের জটিলতা উপেক্ষা করে নথি অনুমোদনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ছাড়াই ইউনেসকোর সদর দপ্তরে সরাসরি প্রস্তাবটি পাঠিয়ে দেন। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেসকো কমিশনের পক্ষে এর সচিব অধ্যাপক কফিলউদ্দিন আহমদের স্বাক্ষরিত সেই প্রস্তাবটি প্যারিসে পৌঁছায়। ১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ শুধু বাংলা ভাষার বিশ্ববিজয় নয়; পৃথিবীর সব মাতৃভাষার বিজয়।
এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়
Leave a Reply