(মানুষ মরে মরুক, এদেশে অবৈধ ব্যবসা চলবেই। কারণ যারা নিয়ন্ত্রণ করবে তাদের চোখে কাঠের চোশমা ও ঘাড়ের উপর দূর্নীতির ভুত চেপে বসে আছে, তাদের শুধু চাই টাকা। বিশেষজ্ঞদের অভিমত ভেজাল খাদ্যের পাশাপাশি মাত্রারিক্ত বিষযুক্ত মশার কয়েলে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ভাবে হুমকির মধ্যে। দেখার কেউ নেই!)
শের ই গুল :
রাজধানী ও তার আশেপাশের জেলা-থানা ঘুরে দেখা যায় অনুমোদনহীন মশার কয়েলের কারখানার সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে চলছে। প্রশাসনের চোখ ফাকি দিয়ে নির্জন স্থানে ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নিয়েই দেদার্সে চলছে কয়েল বানানোর কারখানা।
অনেক সময় প্রশাসন জানলেও প্রতি মাসে উৎকোচ এর বিনিময়ে ছেড়ে দিচ্ছে কারখানার মালিকদের আর মালিক পক্ষ দিনদিন হয়ে যাচ্ছে কোটিপতি। সারা বছরই মশার উপদ্রব বেশি থাকায় বাজারে বিভিন্ন নামে চলছে এসকল কয়েলের জমজমাট ব্যবসা।
অনুমোদনহিন এ সকল মশার কয়েলে মাত্রাতিরিক্ত ‘একটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট (ক্যামিকেল) ব্যবহার করায় জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এ নিয়ে উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের কোন রকম তদারকি নেই। আর ক্রেতারা অজান্তেই মশা থেকে সুরক্ষিত থাকার নামে কিনছে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সকল অননুমোদিত কয়েলে ‘একটিভ ইনটিগ্রেডিয়েন্ট’(ক্যামিকেল) যথেষ্ট ব্যবহারের ফলে ক্যান্সার, শ্বাসনালীতে প্রদাহসহ বিকলাঙ্গতার মতো ভয়াবহ রোগ হতে পারে। এমনকি গর্ভের শিশুও এসব ক্ষতির শিকার হতে পারে। খাদ্যে ফরমালিন ও পানিতে আর্সেনিকের প্রভাব যেমন দীর্ঘমেয়াদী, তেমনি এসব কয়েলের বিষাক্ত উপাদান মানুষের শরীরে দীর্ঘমেয়াদী জটিল রোগের বাসা তৈরি করছে। মানবদেহের সহনশীলতা ও জনস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) মশার কয়েলে ব্যবহার্য একটিভ ইনগ্রেডিয়েন্টের সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) মশার কয়েলে সর্বোচ্চ দশমিক ০৩ মাত্রার ‘একটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট’ ব্যবহার নির্ধারণ করেছে। এই মাত্রা শুধুমাত্র মশা তাড়াতে কার্যকর, মশা মারতে নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনুমোদনহীন ব্যবসায়ীমহল কর্তৃক প্রস্তুত ও বাজারজাতকৃত কয়েলে শুধু মশাই নয়, বিভিন্ন পোকামাকড়, তেলাপোকা এমনকি টিকটিকি পর্যন্ত মারা যায়। বর্তমানে চীন থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কয়েল বাংলাদেশে আমদানিকরা হচ্ছে। এসব গুলোতেও একই অবস্থা।
সূত্র বলছে- এই আমদানিতেও নেই যথাযথ অনুমোদন যা সরকারের চোখে ধুলোদিয়ে চলছে রমরম ব্যাবসা । খোঁজ নিয়ে জানা যায় এসিআই ও বেনকিইজার সহ মশার কয়েল উৎপাদনকারী কয়েকটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাজারে প্রাপ্ত অধিকাংশ কয়েলই সঠিক প্রক্রিয়ায় মান নিয়ন্ত্রিত ও অনুমদিত নাই এবং বিষাক্ত ক্যামিকেল যুক্ত যা স্বাস্থের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। এ বিষয়ে বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত এসব কয়েলের ক্ষতিকর বিষ ফুসফুসের প্রদাহ, ফুসফুসের এলভিওলাই এর পুরুত্ব বাড়িয়ে দেয় ফলে সৃষ্টি হয়।
হাঁপানি, সিওপিডিসহ ফুসফুস ক্যান্সারের মত রোগ হতে পারে এসব বিষাক্ত বিষের কারণে। পাশাপাশি গলা শুকিয়ে যাওয়া, মাথা ঘুরানো, বমিবমি ভাব, বদহজম ইত্যাদি অসুখ হতে পারে। নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ’র মতে, বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদানের কারণে শিশুর বিকাশ কমে যেতে পারে। বড়দের স্মৃতিভ্রম, ঝাঁকুনি, মানসিক দৃঢ়তা, মাথাব্যথার মত সমস্যা হতে পারে। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ’র বিবেচনায় এ ধরনের বিষাক্ত কয়েলের ধুয়া মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
বিষাক্ত উপাদান শরীরের ইমিউন সিস্টেমের ক্ষতিকরে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এছাড়া থাইরয়েড সমস্যাসহ বিভিন্ন অন্তক্ষরা গ্রন্থির ক্ষতি করে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন লিভার- কিডনি বিকল হওয়া, ত্বকে চুলকানি, এ্যালার্জিসহ নানাবিধ চর্মরোগ হতে পারে। গাইনি ও মহিলা রোগ বিশেষজ্ঞ’র মতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক উপাদান মিশ্রিত এ ধরনের কয়েলে উপস্থিত ক্ষতিকারক উপাদান গর্ভবতী মা ও শিশুর মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কয়েলের বিষের প্রভাবে গর্ভস্থ শিশু বিকলাঙ্গ হতে পারে।
দীর্ঘদিন কয়েল ব্যবহারের কারণে বন্ধ্যাত্ব রোগসহ নানা রকমের অসুখ হতে পারে কিছু অসাধু কোম্পানির প্যাকেটের গায়ে কয়েলে ব্যবহৃত ক্যামিকেল এর পরিমান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) কর্তৃক নির্দেশিত অনুমদিত মাত্রার উল্লেখ থাকলেও এসব কয়েলে প্রকৃত পক্ষে ক্যামিকেল অনেক বেশী ব্যাবহারের ফলে তাদের তৈরী কয়েলের ধোঁয়ায়ও মশা,তেলাপোকা সহ অনেক কিট-পতঙ্গই মরছে যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই বিএসটিআই কর্তৃক অনুমোদিত। এ বিষয়ে বিএসটিআই কর্তৃপক্ষের তদারকিতে অবহেলার অভিযোগ করেন কয়েকটি কয়েল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যাক্তিরা।
বর্তমানে বাজার দখল করে থাকা এ ধরনের কয়েলগুলোর মধ্যে সুপরিচিত কয়েকটি নাম হল- সোনালি, নাইটগার্ড, কুবরা, লিজার্ড, এ্যাটাক কিং, ফাইটার কিং, কিং কোবরা, ব্ল্যাক কোবরা, চিতা কোবরা, ঈগল, মর্টিন, পেঙ্গুইন, দোয়েল,সিডর, সুনামি, বাহারপাতা, কলাপাতা, জম, বসুন্ধারা, প্রমি, সুপার ডিসকভারি, মাছরাঙ্গা, সোনালী কিং, বস, পাওয়ার, প্যাগোডা গোল্ড, তুলসী পাতা, সুপার ফিলিপস ডিআইএম জাম্বু, অ্যাটাং কিং ,সেইফ গার্ড, এক্সট্রা হাই পাওয়ার, লিজার্ড মেগা, বস সুপার, টাটা হাই স্পিড, মেট্রো, সুপার জাদু, মাছরাঙ্গা কিং, সুপার সান পাওয়ার, এ-জেড মেঘনা, মারুফ পাওয়ার ম্যাজিক, পোলার, মাছরাঙ্গা মেঘা, বাংলা কিলার,হান্টার বিচ্ছু,চমক,সুপার যাদু,তুলসি পাতা,সোনালী কিং,রকেট,সুপার যাদু,সুপার সান পাওয়ার,এক্সট্রা পাওয়ার বুষ্টার কয়েল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য নামে। অনুমোদনহীন বেশকিছু কারখানা মশার কয়েলে মাত্রাতিরিক্ত ‘একটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট’র ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এ নিয়ে সরকারের তদারকি নেই। আর ক্রেতারা অজান্তে সুরক্ষিত থাকার নামে কিনছে ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি! সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন মহল্লায় দেখা গেছে, মিনি পলিথিনের মধ্যে ৫ টি কয়েল তুলে বিক্রি করছে হকাররা।
এই ৫টি কয়েলের দাম রাখা হচ্ছে ১০ টাকা। সেই সাথে ক্রেতারাও হরহামেশায় সস্তায় কিনছি এসব কয়েল। এছাড়াও বিভিন্ন মূল রাস্তার মোড়ে পলিথিন ব্যাগে কয়েল বিক্রি করা দেখা গেছে। রোগতত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা কেন্দ্রের (আইইডিসিআর) পরিচালক দৈনিক আমার প্রাণের বাংলাদেশকে বলেন, এ ধরণের রাসায়নিকের যথেচ্ছ ব্যবহার সব বয়সী মানুষের জন্যই ক্ষতিকর। তবে শিশুদের উপর এটি দ্রুত প্রভাব বিস্তার করে। তিনি আরও বলেন, প্রতিনিয়ত এ ধরণের রাসায়নিকের সংস্পর্শ তাৎক্ষণিকভাবে নয়, সূদূরপ্রসারী ক্ষতি করে। বর্তমানে চীন থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কয়েল আমদানি করা হচ্ছে। এসবেও একই অবস্থা। সূত্র বলছে- এই আমদানিতেও নেই যথাযথ অনুমোদন।
বিদ্যমান বালাইনাশক অধ্যাদেশ- (পেস্টিসাইড অর্ডিন্যান্স ১৯৭১ ও পেস্টিসাইড রুলস ১৯৮৫) অনুসারে, মশার কয়েল উৎপাদন, বাজারজাত ও সংরক্ষণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। অধ্যাদেশ অনুযায়ী- অধিদপ্তরের অনুমোদন পাওয়ার পর পাবলিক হেলথ প্রোডাক্ট (পিএইচপি) নম্বর ও বিএসটিআই’র অনুমোদন নিয়েই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে বালাইনাশক পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মারাত্মক ক্ষতিকর কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাত করছে কয়েকশত দেশীয় বেনামি কারখানা।
ভুয়া পিএইচপি নম্বর ও বিএসটিআই’র লোগো ব্যবহার করে আকর্ষণীয় মোড়কে এসব কয়েল বাজারে ছাড়া হচ্ছে। এছাড়া বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে উচ্চমাত্রার একটিভ ইনগ্রেডিয়েন্টে সম্পন্ন চায়না কয়েল। দেশের বাজার এসব কয়েলে সয়লাব হলেও এর বিপরীতে সংশ্লিষ্টদের কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই বলে অভিযোগ অনুমোদিত দেশীয় কোম্পানিগুলোর। অন্যদিকে, মাত্রাতিরিক্ত ‘একটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট’ সমৃদ্ধ কয়েলের কার্যকারিতা বাজারের প্রচলিত প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড যেমন এসিআই, মরটিনের চেয়ে অনেক বেশি। তাই স্বাভাবিকভাবেই ক্রেতারা এসব অননুমোদিত কয়েলের প্রতিই বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন বলে বিক্রেতারা জানান।
এছাড়া দেশের বাইরে থেকে মশার কয়েল আমদানি করার ক্ষেত্রে একটি সুর্নিদিষ্ট নীতিমালা গঠনে গুরুত্বারোপ করেন তিনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক (উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং) দৈনিক আমার প্রাণের বাংলাদেশকে বলেন, অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়া কেউ কয়েল উৎপাদন করতে পারে না।
কিন্তু কিছু কারখানা আমাদের অনুমোদন ছাড়াই কয়েল প্রস্তুত ও বাজারজাত করছে বলে অভিযোগ এসেছে। অভিযোগের ভিত্তিতে আমাদের কাজ চলছে। সম্প্রতি এই কর্মকর্তা চিঠির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানান, ইদানিং বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃক পণ্য রেজিস্ট্রেশন ও আমদানি লাইসেন্স ছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে কীটনাশকের সক্রিয় উপাদান, ফিনিশড প্রোডাক্ট মশার কয়েল, অ্যারোসল ইত্যাদি আমদানির জন্য বিভিন্ন কোম্পানির আবেদনে ব্যাংক এলসি প্রদান করে আসছে। এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সার্কুলার জারি করে।
যাতে বলা হয়েছে, কীটনাশক ও বালাইনাশক আমদানির জন্য ঋণপত্র ইস্যুর আগে কীটনাশক অধ্যাদেশ ১৯৭১-এর অধীনে প্রণীত কীটনাশক বিধিমালা ১৯৮৫ অনুযায়ী আমদানিকারকের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রয়োজনীয় পণ্য রেজিস্ট্রেশন সনদ ও আমদানি নিবন্ধন যথাযথ আছে নিশ্চিত হয়ে এ-সংক্রান্ত নথি যথাযথভাবে সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হলো।
বিএসটিআইর সহকারী পরিচালক (সিএম) দৈনিক আমার প্রাণের বাংলাদেশকে জানান, ঢাকা বিভাগের মধ্যে ৪০-৫০ টি ব্র্যান্ডের মশার কয়েল তৈরির অনুমোদন রয়েছে তাদের। এ ব্র্যান্ডের বাইরে কেউ কয়েল উৎপাদন করলে তা অবৈধ ও অনুমোদনহীন। তাদের বিরুদ্ধে বিএসটিআই পর্যায়ক্রমে কাজ করছে বলে জানান তিনি।
এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়
Leave a Reply