সোমবার, ২০ মার্চ ২০২৩, ০২:৫৯ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :

দেশব্যাপী পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ যত দোষ নন্দ ঘোষ বাকীরা কি সাধু ?

Reporter Name
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ, ২০২৩
  • ২২ Time View

 

 

(শুল্ক বিভাগের কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষ বোঝে না, প্রকৌশল বিভাগে কি হয় গণমানুষ তার খবরই রাখেন না। বন বিভাগের কোন কর্মকর্তা যে অবৈধ অর্থের পাহাড় জমাতে পারেন, সাধারণ মানুষ তা জানেন না। তাই ঘুষ বলতে তারা পুলিশ কর্তৃক গ্রহণ করা উপরি পাওয়া অর্থকেই বোঝেন।)

 

শের ই গুল :

 

শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরতের কুয়াশা-রৌদ্র-বৃষ্টি-বাদল রক্ত-মাংসের শরীরে প্রতিবাদহীনভাবে ধারণ করে চৌরাস্তার মোড়ে ১০/১২ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে দায়িত্ব পালনকালীন কোন ট্রাফিক কনস্টেবল যাত্রীবাহী বাসের ড্রাইভার বা হেলপারের দিকে ঘর্মাক্ত হাত প্রশস্ত করে যে পরিমাণ উৎকোচ গ্রহণ করে, সেই উৎকোচের অর্থের অংক একই চৌরাস্তার মোড়ে মাটির শানকি হাতে ভিক্ষারত ভিক্ষুকটির দৈনিক উপার্জনের চেয়ে কোন ভাবেই বেশী হবে না।

দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সেবা নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছে বলে উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রতিবেদনে। সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর কাছে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয় ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বলতে বোঝানো হয়েছে পুলিশ, র‌্যাব ও আনসারের মতো বাহিনীগুলোকে। ঘুষ ও দুর্নীতির প্রসঙ্গ এলেই বাংলাদেশের মানুষের মানসপটে যে সরকারি কর্মচারীদের চেহারা ভেসে ওঠে, তারা হল পুলিশ। ইতিহাসের আদ্যিকাল থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত ঘুষের প্রতিমূর্তি হিসেবে পুলিশ মানুষের ঘৃণা, অনাস্থা, অসহযোগিতা ও অচ্ছুতপনা মহাদেবের মতো গরলসম কন্ঠে ধারণ করেছে। কিন্তু মানুষের বিচারে দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত পুলিশ আর যাই হোক, মহাদেবের মতো নীলকন্ঠ হতে পারে নি।

তারা সভা-সমিতি, মিছিল-মিটিং, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম সব স্থানেই থাকে অনুচ্চকন্ঠ। কারণ, চোরের মায়ের বড় গলা থাকতে নেই! কিন্তু, দুর্নীতি সম্পর্কে গণমানুষের ধারণা পূর্বসংস্কার প্রসূত এবং অতিশয় সারল্য দোষে দুষ্ট। তারা চোখের সামনে যা দেখেন, কানে যা শোনেন, তার বাইরে খুব কমই চিন্তা করেন। অন্যদিকে, খবরের কাগজে প্রকাশিত খবরকেও তারা বিশ্লেষণ করতে অভ্যস্ত নন। তাই তাদের সামনে মলিন চেহারার ট্রাফিক কনস্টেবল কর্তৃক বাসের ড্রাইভারের কাছ থেকে দুই টাকা বখশিস নেওয়াই হল আলোচিত দুর্নীতি; থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক কোন নিরীহ কৃষককে হয়রানী করা হল বড় ক্ষমতার অপব্যবহার। শুল্ক বিভাগের কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষ বোঝে না, প্রকৌশল বিভাগে কি হয় গণমানুষ তার খবরই রাখেন না। বন বিভাগের কোন কর্মকর্তা যে অবৈধ অর্থের পাহাড় জমাতে পারেন, সাধারণ মানুষ তা জানেন না।

তাই ঘুষ বলতে তারা পুলিশ কর্তৃক গ্রহণ করা উপরি পাওয়া অর্থকেই বোঝেন। পুলিশ ছাড়া অন্য কেউ ঘুষ গ্রহণ করেন কিংবা পুলিশ ছাড়া অন্য কারো উপরি পাওনা যে ঘুষ-দুর্নীতির পর্যায়ভূক্ত তা অনেকেই মনে করেন না। কিন্তু সমপ্রতি জার্মান ভিত্তিক বেসরকারি আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ অফিসের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে যে সিদ্ধান্তে উপণিত হয়েছে তাতে ঘুষ ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশ তাদের ঐতিহ্যবাহী শীর্ষ স্থানটি খোয়াতে বসেছে। টিআইবি ২০০০ সালে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল তাতে বাংলাদেশকে প্রথম বারের মতো দুর্নীতির ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ স্থানে উঠে আসে। মাঝখানের বছর গুলোতে কিছুটা হেরফের হলেও ২০২১ সালে দুর্নীতির শীর্ষ স্থানটি আবার পুলিশ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ঐ সময় বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির মধ্যে পুলিশকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়া হয়।

টিআইবি এর সেই সময়ের গবেষণা ছিল শোনা কথার উপর; পূর্বসংস্কার প্রভাবিত। কারণ, আমাদের বাপ-দাদারা যে পুলিশকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে জন্ম-জন্মান্তরে জেনে এসেছেন, দুর্নীতিবাজ হিসেবে তাদেরকে দ্বিতীয় সারিতে স্থান দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ২০০০ সালের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। প্রচার মাধ্যমের স্বচ্ছতা, মান ও সচেতনা যেমন বেড়েছে, টিআইবিও তেমনি একমাত্র পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের উপর নির্ভরশীল না থেকে নিজস্ব উদ্যোগে প্রাথমিক ডাটা সংগ্রহের দিকেও মনোনিবেশ করেছে। ”আন্তর্জাতিক স্বচ্ছতা ” নামের এই সংগঠনটি স্বচ্ছতর হতে গিয়ে পুলিশের জন্য নির্ধারিত শীর্ষ অবস্থানটিকে নড় বড়ে করে তুলেছে।

সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত তো দূরের কথা বাংলাদেশ পুলিশ এখন আর দুর্নীতির ক্রম-তালিকায় তার নামটি পর্যন্ত রাখতে পারছে না। কিন্তু কিভাবে? সরকারের পক্ষে যারা অর্থ রোজগার করেন কিংবা সরকারের পক্ষে অর্থ ব্যয় করেন সাধারণতঃ তারাই সরকারি অর্থে পিতৃশ্রাদ্ধ করতে পারেন। সরকারি সেবা খাত- যেমন ব্যাংক, বীমা, ডাক, তার, টেলিফোন, ট্যাক্স, আবগারী শুল্ক, রেল, সড়ক ও জনপথ, স্থানীয় সরকার ইত্যাদি বিভাগ সরকারের পক্ষে রেভিনিউ সংগ্রহ করে কিংরা সরকারের পক্ষে অর্থ ব্যয় করে। অর্থাৎ এই সব বিভাগ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। সরকারি ক্রয় ও বিক্রয় সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে এই সব দপ্তর ও পরিদপ্তর/বিভাগ জড়িত। তাই এই সব বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীগণ দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ সরাসরি পকেটস্থ করা কিংবা সরকারের ঘরে লাল বাতি জ্বালিয়ে বেসরকারি ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পারসেনটেজ নিতে পারেন বা তাদের পক্ষে দুর্নীতির বখরা বাগানো সম্ভব। কোটি কোটি টাকার তুলনায় পুলিশের এই অংশ ভিক্ষা বৃত্তির সাথে তুলনা করাই বাঞ্ছনীয়। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত প্রণীত বাংলাদেশে কালো টাকা ও এর উৎস নামক গবেষণা পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে ২০০৪ সালে দুর্নীতির আর্থিক পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার কোটি টাকা।

১৯৯১ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা। ৭০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৫৮ হাজার কোটি টাকা বৈধ আয় উদ্ভূত এবং মাত্র ০৪ হাজার কোটি টাকা নিরেট ঘুষের মাধ্যমে আহরিত। আবুল বারাকাতের মতে মোট দুর্নীতির মধ্যে ঘুষ হল মাত্র ৫.৭%। কেবল পুলিশই ঘুষ খায় আর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা সরকারি-বেসরকারি প্রকল্প-পরিচালকরা ধোয়া তুলশীর পাতা নিশ্চয় এমনটি কেউ বিশ্বাস করবেন না। তাই ৭০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে(৫.৭%) পুলিশের ভাগে কত টাকা এসেছে সচেতন মানুষ তা সহজেই অনুমান করতে পারবেন। টিআইবি এর রিপোর্টে আর্থিক বিবেচনায় দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান বা খাত গুলোর মধ্যে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে বর্তমানে ২০২১ সালে পুলিশ বিভাগ শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছে। পুলিশকে বাংলাদেশের মানুষ যত বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মনে করে, বিদেশীরা কিন্তু ততো বেশী দুর্নীতিবাজ বলে মনে করেন না।

কারণ, বিদেশীরা, যারা বাংলাদেশে অবস্থিত আন্তর্জাতিক মিশনে কাজ করেন কিংবা বাংলাদেশে নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন, পুলিশ সম্পর্কে তাদের পূর্বসংস্কার নেই। তারা আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার উপর সাধারণ ধারণা পোষণ করেই আমাদের বিভিন্ন খাতকে পর্যালোচনা করেন। অধিকন্তু, বিদেশী দাতারা এখন পর্যন্ত পুলিশের উন্নয়নে খুব বেশি অর্থ খরচ করেননি কিংবা পুলিশের উন্নয়নমূলক কোন প্রকল্পের কোন টেন্ডার প্রতিযোগিতাতেও তারা অংশ গ্রহণ করেননি। তাছাড়া পুলিশের কোন যন্ত্রপাতি বা যান বাহন কেনার জন্য যে অর্থ খরচ হয় বা টেন্ডার আহ্বান করা হয় সেখানে পুলিশ সদস্যদের খুব বড় ভূমিকা নেই। তাই আর্থিক দুর্নীতির ব্যাপারে বিদেশী দাতারা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়কারীদের চরিত্র ভাল ভাবেই পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। আর এজন্য বিশ্বব্যাংকের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর ক্রিস্টিন ওয়ালিচকে বিদ্যুৎ খাত সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্থ খাত বলে মন্তব্য করতে এবং দুর্নীতি সম্পর্কে প্রকাশ্য সেমিনারে তৎকালে জনৈক মন্ত্রীর সাথে বির্তক করতেও দেখা যায়। তাহলে পুলিশের এত দুর্নাম কেন? টিআইবি এর রিপোর্টে এর কারণও দেয়া আছে। মানুষ যেমন কেবল পুলিশের দুর্নীতির খবর নিয়ে যাবর কাটে, তেমনি পত্রিকাগুলো পুলিশের দুই টাকার ঘুষ নিয়ে বড় বড় রিপোর্টও তৈরি করে। তাই, টাকার অংকে নয়, ঘুষের ঘটনার দিক থেকে পুলিশ অগ্রগামী বটে। কারণ, টিআইবির রিপোর্ট অনুসারে ওয়াসার কোটিপতি ড্রাইভারের দুর্নীতির ঘটনা আর ট্রাফিক কনস্টেবলের দুই টাকা ঘুষ খাওয়ার ঘটনা একই পাল্লায় মাপা হয়।

তবে দুর্নীতির ঘটনার সংখ্যার ক্ষেত্রেও পুলিশ খুব একটা বেশি এগিয়ে নেই। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর গুলোর সাংখ্যিক বিচারে পুলিশ ১৫.১৮ পয়েন্ট নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ১২ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থান পেয়ে পুলিশকে প্রায় ধরে ধরে অবস্থা। এর পর শিক্ষা বিভাগ রয়েছে ১০.৪ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় স্থানে ও ১০.১০ পয়েন্ট নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ চতুর্থ স্থানে। তথ্যগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, টিআইবি পুলিশকে শীর্ষে নিয়ে আসার জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করেছে। পুলিশের ঘুষের পরিমাণ নিম্ন আদালতের ঘুষের পরিমাণের চেয়ে সামান্য উপরে। কিন্তু ভূমি রেজিষ্ট্রেশন ও ভূমি খারিজকে পৃথক করে দেখানো হয়েছে। অথচ বিষয়টিকে পৃথকভাবে দেখানোটা সঠিক নয়। ভূমি রেজিষ্ট্রেশন ও খারিজের কর্মচারীগণ আসলে একই শ্রেণীর কর্মকর্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

পুলিশকে ঢালাও ভাবে ঘুষ খোর বলাও বড় অন্যায়। কারণ, পুলিশের সিনিয়র লেভেলে খুবই কম সংখ্যক লোক কাজ করে। পুলিশের ২ লক্ষ ৪৫ হাজার সদস্যের মধ্যে শতকরা তিরানব্বই ভাগ হয় কনস্টেবল নয়তো কনস্টেবল পদে ভর্তি। অধীনস্তদের নিয়ন্ত্রণ, মামলা রুজু, মামলা তদন্ত, তদন্ত তদারকী, আসামী গ্রেফতার, খানা তল্লাশী ইত্যাকার পুলিশী কাজের সাথে সরাসরি জড়িত পুলিশ সদস্যের সংখ্যা তাদের মোট সংখ্যার অতি সামান্য। পুলিশ লাইন্সে বসবাসকারী নায়েক, হাবিলদার, সুবেদারদের কে ঘুষ দিতে আসবে? রিজার্ভ ফোর্স বা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে কর্মরত পুলিশ অফিসারদের অপারেশনাল কার্যক্রম নেই। থানায় কর্মরত সেন্ট্রি ডিউটি করা গোবেচারা কনস্টেবলটি কতটা দুর্নীতি করতে পারে? তাছাড়া এত বড় একটি সংগঠনে প্রকৃত সৎ লোক এক জনও নেই এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। পুলিশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিটি থেকে নিম্ন স্তর পর্যন্ত অনেক সৎ ও আদর্শবান ব্যক্তি আছেন যারা অন্যদের কাছে অনুশরণীয় চরিত্রের অধিকারী।

অথচ ঘুষ-দুর্নীতির অপবাদ দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা এ সবের কাউকেই বাদ দেই না। অনেক সরকারি দফতর আছে যেখানে কর্মরত মাত্র দুই হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী সরকারের কয়েক শত কোটি টাকা পকেটস্থ করেছে বলে জন সম্মুখে স্বীকারোক্তি পর্যন্ত দিয়েছে। তাদের মধ্যে আবার ১৬৭ জনই কোটি পতি হয়েছেন ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থে। অনেক অফিসের পিওন, সিবিএ নেতা এবং দারোয়ানগণ পর্যন্ত বিপুল অর্থের মালিক বনে যান। সেখানে কর্মরত প্রায় প্রত্যেক ব্যক্তিই দুর্নীতির সুযোগ পেয়ে থাকেন। কিন্তু পুলিশে কর্মরত সদস্যদের মধ্যে দশ থেকে বার শতাংশের বেশী সদস্য দুর্নীতির সুযোগই পায় না।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষককে যদি সৎ বলতে পারি, তাহলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে কর্মরত পুলিশের কনস্টেবলকে কোন যুক্তিতে অসৎ ভাবতে হবে? এবার দেখা যাক ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ কে কিভাবে খরচ করেন। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজ পকেট থেকে বাধ্যতামূলকভাবে অর্থ খরচ করতে হয় একমাত্র পুলিশ বিভাগের কর্মচারিদেরকেই। পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টরের তদন্তের ব্যয়, আসামী গ্রেফতেরের খরচ, পোস্টমর্টেমের জন্য লাশ পরিবহনের ব্যয়, প্রতি মাসে পূর্ববর্তী কর্মস্থলে অবস্থিত আদালতে মামলার সাক্ষ্য দেয়ার জন্য যাতায়াত ইত্যাদি হাজারো কাজে ঘুষের মাধ্যম অজিত অর্থ ব্যয় হয়।

কিন্তু শিক্ষা ভবনের একজন কেরানী বা শুল্ক বিভাগের একজন পিয়ন তার ঘুষের অর্থে বাধ্যতামূলক ভাবে সরকারি দায়িত্ব পালন করেন বলে আমাদের জানা নেই। কেবল পুলিশ বিভাগের কর্মচারীগণই গরু মেরে গুরুকে জুতো দান করেন। এমন ঘটনা বিরল নয় যে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থানায় রক্ষিত সর্বাধিক পরিচিত জিডি বই খানাও ঘুষের টাকায় তৈরি করে থাকেন ( বর্তমানে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে)। কোর্টে কর্মরত পুলিশগণ নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে বিভিন্ন ধরণের রেজিস্টার পত্র কিনেন। এমনকি আদালতের অর্ডার শীট পর্যন্ত তাদের নিজ অর্থে কিনতে হয় বলে পত্রিকায় মাঝে মধ্যেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অফিসে গিয়ে অনেকে এক কাপ চা প্রত্যাশা করেন।

থানায় আগত ব্যক্তিদের আপ্যায়ণের জন্য উপর থেকে নির্দেশনাও আসে। কিন্তু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আপ্যায়ণের ব্যয় কোথা থেকে মেটাবেন তার কোন নির্দেশনা নেই। রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে বুধবার সংস্থাটির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় খানা জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেবাদানে দুর্নীতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরই অবস্থান পাসপোর্ট অধিদপ্তরের।

এ সংক্রান্ত সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হন ৭০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। এদিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। গত বছর এ সংস্থাটির সেবা নিতে গিয়ে ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ দুর্নীতির শিকার হন। এর বাইরে বিচারিক সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতিতে পড়েছেন ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য খাতে সেবা পেতে দুর্নীতির শিকার হন। ১৭টি খাতের ওপর জরিপ চালায় টিআইবি। খাতগুলো হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা, শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত), স্বাস্থ্য (সরকারি), কৃষি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, বিমা, কর ও শুল্ক, ব্যাংকি, এনজিও (প্রধানত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ) এবং অন্যান্য (জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ সহায়তা, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন শপিং, ওয়াসা, নির্বাচন কমিশন, ডাক বিভাগ, সমাজসেবা অধিদপ্তর ইত্যাদি)। দেশের আটটি বিভাগকে গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চল বিবেচনায় ১৬টি স্তরে বিভাজন করে দৈবচয়নের মাধ্যমে ১ হাজার ৩২০টি মহল্লায় জরিপ চালানো হয়। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ৮২০ এবং শহরাঞ্চলে ৫০০টি গ্রাম বা মহল্লায় এ কাজ করা হয়। সেখান থেক ১০০ খানার তালিকা করে ১২টি খানা দৈবচয়নের মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়।

১৫ হাজার ৪৪৫টি খানা জরিপে অংশ নেয়। মূলত একই পরিবারে বসবাসকারী একজনকে খানাপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী- গবেষণায় দেখা গেছে ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দুর্নীতির শিকার হন। পাশপাশি ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ ঘুষের শিকার হন। এ খাতে খানাপ্রতি গড় ঘুষের পরিমাণ ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা। পাসপোর্ট অধিদপ্তর- ৭০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ জানান তারা তাদের পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন। গড় ঘুষের পরমিাণ ৫ হাজার ৫৫৫ টাকা। বিআরটিএ- ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ জানান তারা বিআরটিএ সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ৫০ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন। এ খাতে গড় ঘুষের পরিমাণ ৫ হাজার ১৪৭ টাকা।

বিচারিক সেবা- গবেষণায় অংশ নেয়া ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ নাগরিক জানান তারা বিচারিক সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন। এ খাতে গড় ঘুষের পরিমাণ ১৯ হাজার ৯৬ টাকা। স্বাস্থ্য (সরকারি)- গবেষণায় অংশ নেয়া ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ নাগরিক জানান তারা সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ৬ দশমিক ২ শতাংশ মানুষকে ঘুষ দিতে হয়েছে। এ খাতে গড় ঘুষ ৬৮০ টাকা। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান- গবেষণায় অংশ নেয়া ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ নাগরিক জানান তারা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।

অন্যদিকে এ সেবা পেতে ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন, এ খাতে গড় ঘুষের পরিমাণ ১ হাজার ১২ টাকা। ভূমি সেবা- ৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ নাগরিক জানান তারা ভূমি সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষকে ঘুষ দিতে হয়েছে। যেখানে গড় ঘুষের পরিমাণ ৭ হাজার ২৭১ টাকা। শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত)- গবেষণায় অংশ নেয়া ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ নাগরিক জানান তারা শিক্ষা সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন। এ খাতে গড় ঘুষের পরিমাণ ৭০২ টাকা। বিদ্যুৎ- ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন। এ খাতে গড় ঘুষের পরিমাণ ৩ হাজার ২৮৬ টাকা। জলবায়ু পরিবর্তন- ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ নাগরিক জানান তারা জলবায়ু পরিবর্তন সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন, যা গড় ঘুষের পরিমাণ ১ হাজার ৩৬৫ টাকা।

কৃষি- ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ কৃষি সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন বলে জানান। এদের মধ্যে সেবা পেতে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন। যার গড় পরিমাণ ২৬৬ টাকা। এ ছাড়া বিমা, ব্যাংকিং, গ্যাস, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন শপিং, ওয়াসা, নির্বাচন কমিশন, ডাক বিভাগ, সমাজসেবা অধিদপ্তর ইত্যাদি খাতেও মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। আর এসব সেবা নিতে গিয়েও ঘুষ দিতে হয়েছে। শহরের মানুষের চেয়ে গ্রামের মানুষ দুর্নীতির শিকার বেশি- টিআইবির গবেষণায় উঠে এসে সেবাখাতে সার্বিকভাবে ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানা সেবাখাতে দুর্নীতির শিকার হন।

যারমধ্যে গ্রামের মানুষ দুর্নীতির শিকার বেশি হন। গ্রামের ৭১ দশমিক ২ শতাংশ সাগরিক সেবাখাতে দুর্নীতির শিকার হন, পাশাপাশি শহরের ৭০ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। অন্যদিকে গণেষণায় দেখা গেছে, সার্বিকভাবে ৪০ দশমিক ১ শতাংশ নাগরিক সেবাখাতে ঘুষের শিকার হন। তবে গ্রামের ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ নাগরিকরা এ ঘটনার সম্মুখীন হন। শহরে এর পরিমাণ কম। শহরের ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ নাগরিকরা সেবা পেতে ঘুষের ব্যবহার করেন। তবে গ্রামের প্রতিটি খানায় গড় ঘুষের পরিমাণ ৪ হাজার ৫৫৫ টাকা।

অন্যদিকে শহরে খানাপ্রতি এ পরিমাণ ৮ হাজার ৫০ টাকা। শহর গ্রাম মিলিয়ে খানাপ্রতি গড় ঘুষের পরিমাণ ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা। পুরুষের চেয়ে নারীরা দুর্নীতির শিকার বেশি হন- গবেষণায় দেখা যায়, লিঙ্গভেদে পুরুষের চেয়ে নারীরা দুর্নীতির শিকার বেশি হন। তবে তারতম্যের পরিমাণ খুব একটা বেশি না। ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ নারীরা দুর্নীতির শিকার হলেও পুরুষের ক্ষেত্রে সে পরিমাণ ৭০ দশমিক ৭ শতাংশ। নারীদের চেয়ে ঘুষ বেশি দেয় পুরুষ- সেবাখাতে সেবা পেতে নারীদের চেয়ে পুরুষরা বেশি ঘুষ দিয়ে থাকে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। সেবা পেতে ৪০ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষেরা ঘুষের আশ্রয় নিয়ে থাকে।

তবে নারীদের ক্ষেত্রে সে পরিমাণ ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ। গবেষণায় অংশ নেয়া ৭২ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া যায় না। ২০২১ সালে জাতীয় পর্যায়ে প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। যা জাতীয় সংশোধিত বাজেটের ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। বাংলাদেশের জিডিপির শূন্য দশমিক শতাংশ।

 

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়