বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩, ০১:১৯ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :
টঙ্গীতে জমি আত্মসাৎ এর জন্য নিজের মাথায় আঘাত করে মিথ্যা মামলা সাজালেন ছোট ভাইসহ তিনজনের বিরুদ্ধে বাঞ্ছারামপুরকে ভূমিহীন ও গৃহহীন মুক্ত ঘোষনা করার লক্ষে ইউএনও এর প্রেস ব্রিফিং মিরপুরে ছিনতাইকারী চক্রের ৫ সদস্য গ্রেফতার : দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করলে ব্যবস্থা: খাদ্যমন্ত্রী চেম্বার আদালতেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে রিট খারিজ ইলিয়াস-বাবুলের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদনের নতুন দিন ধার্য টাঙ্গাইল-৩ আসন আওয়ামীলীগের গৃহবিবাদের সুযোগ নিতে চায় বিএনপি হজ পালনে থাকছে না বয়সসীমা, শর্ত তুলে নিলো সৌদি আরব কুষ্টিয়ায় পরিবারের সবাইকে রুমে আটকে দুর্ধর্ষ ডাকাতি, ১৫ লাখ টাকার মালামাল লুট কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোন কর্তৃক শরণখোলায় বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান

দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক মুর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছে

Reporter Name
  • Update Time : সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
  • ২২ Time View

 

 

(দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে থাকা আইনটি যেন মানুষের বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক মুর্তিমান আতংকে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যম তো বটেই, এমনকি সামাজিক মাধ্যমে যারা নিজেদের মত প্রকাশ করে থাকেন, তাদেরকে সবসময়ই আতংকে থাকতে হয়।)

 

শের ই গুল :

 

একটা বিষয় লক্ষণীয়, বেশির ভাগ মামলার বাদীই হচ্ছে সরকার পক্ষীয় লোকজন। সরকারী দলের নেতা, কর্মী, এমপি, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার, এমনকি সরকারী কর্মকর্তাও বাদী হয়েছেন অনেক মামলার। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের গোবিন্দাসির বর্তমান চেয়ারম্যান দুলাল চকদার সার্টিফিকেটধারী বিএনপি’র নেতা, ধর্ষণ মামলার আসামী, খুনি মামলার আসামী হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করলে সম্পাদকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়।

আসলে আইনটাই এমন যে, এর মধ্যে যে কাউকে যে কোন সময় ফেলে দেওয়া যায়। যে কোন দেশেই আইন তৈরি হয় জনগণের সুবিধা অসুবিধার কথা বিবেচনা করে। সুবিধার কথা মাথায় রেখে তৈরি আইনের কারণে যদি অসুবিধার মাত্রা বেড়ে যায়, তখন আবার আইনে পরিবর্তনও আসে, অনেক সময় তা বাতিলও হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় এর উল্টো প্রবণতা। দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে থাকা আইনটি যেন মানুষের বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক মুর্তিমান আতংকে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যম তো বটেই, এমনকি সামাজিক মাধ্যমে যারা নিজেদের মত প্রকাশ করে থাকেন, তাদেরকে সবসময়ই আতংকে থাকতে হয়, এই বুঝি তার উপর এই আইনের খড়গ নেমে এলো।

অথচ, এই আইনটি প্রণয়নের আগে অনেক আলোচনা হয়েছিল, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ নানা ধরনের মতামত দিয়েছিল। মর্মান্তিক হলো, আইন প্রণয়নের সময় সেসব মতামতের সিংহভাগকেই উপেক্ষা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে পাস হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এর আগে তথ্য প্রযুক্তি আইন নামে প্রায় একই রকম আরও একটা আইন ছিল। সেটির কয়েকটি ধারা নিয়ে খুব সমালোচনা হয়। সরকারের একাধিক মন্ত্রীও স্বীকার করেন, কিছু সমস্যা আসলেই রয়ে গেছে। সেই সমস্যা দূর করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা নামে নতুন এই আইন। কিন্তু দেখা গেল, আগের আইনে যে ৫৭ ধারা নিয়ে এত আপত্তি, এত সমালোচনা, সেটিই কয়েকটি ধারায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে গেছে নতুন আইনেও। এ নিয়েও আপত্তি ওঠলো। বলা হলো- ৫৭ ধারা তো গেল না, বরং আরও ডিটেইলে জায়গা করে নিল। আগের সেই মন্ত্রীরা এবার আর কিছু বললেন না। পাস হয়ে গেল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।

পাস হওয়ার সময় জাতীয় সংসদে সেই সময়কার টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেছিলেন, তিনি নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করছেন। তিনি এমনও আশা করলেন, এটি এমনই ভালো একটি আইন যে, আগামী কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীর বহু দেশ এটা অনুসরণ করবে। এরকম আইন তারাও প্রণয়ন করবে। মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের সেই আশাবাদের পর এর মধ্যে প্রায় কয়েক বছর হয়ে গেছে। যতদূর জানি- এখনো কোন দেশ আমাদেরকে অনুসরণ করেনি। বরং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে আমরা এই আইনের কারণে সমালোচিত হয়েছি, রেটিংয়ে পিছিয়ে পড়েছি। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার এর মুক্তসাংবাদিকতার তালিকায় আমাদের অবস্থান এই নতুন আইনের পর কয়েক ধাপ পিছিয়েছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ছিল ১৪৬তম অবস্থানে, আইন প্রণয়নের পর ২০১৯ সালে অবস্থান হয়েছে ১৫০তম।

অর্জনের মধ্যে এতটুকুই। এই যে অবনমন, সরকার অবশ্য এটা মোটেই স্বীকার করে না। প্রায় ২৫ বছর ধরে আমি সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত। আমার মত আরও অনেক সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা যা-ই হোক না কেন, সরকার কিন্তু বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করে থাকে যে, দেশ স্বাধীনতার পর থেকে এ যাবত কালের মধ্যে বর্তমান সরকারের সময়ে মিডিয়া সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে! আসলে সমস্যাটা হয়েছে কি, পৃথিবীজুড়ে এমন একটা সময় এসেছে যে, এখন আর কাউকে কষ্ট করে কিছু প্রমাণ করতে হয় না। কেবল মুখ ফুটে দাবি করলেই হয়। কি বলা হলো সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, কে বললো- সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। কয়েক বছর আগে আমাদের তথ্যমন্ত্রী গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে।

সেখানে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বেশ দায়িত্ব নিয়ে বললেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যম খোদ ব্রিটেনের গণমাধ্যমের চেয়েও বেশি স্বাধীন! এমন নয় যে বিবিসি আমাদের দেশ সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। আমাদের স্বাধীনতার আগে থেকেই তারা বাংলাদেশে কাজ করছে। এখানে তাদের অফিস রয়েছে, সেখানে কর্মরত অধিকাংশ সাংবাদিকও বাংলাদেশী। তারা সেখানে কাজ করতে যেয়ে, এই দেশে বাস করতে যেয়ে নিশ্চয়ই জানেন কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে আমাদের গণমাধ্যম। তারপরও তথ্যমন্ত্রী বেশ হাসিমুখেই এমন দাবি করে থাকেন। উনি নিজেও জানেন, কতটুকু সত্য তিনি বলেছেন।

আবার এটাও জানেন, এই যে দাবিটা তিনি করছেন- সেটা কতটুকু বিশ্বাস করছে বিবিসি বা বিবিসির দর্শক শ্রোতারা। সবই জানেন, তবুও বলেন। এই বলাটাই আসলে তার কাজ, এটাই তার চাকরি। এই বলার কাজটা তিনি কতটা আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়তার সঙ্গে করতে পারছেন, তার উপর নির্ভর করে তার চাকরির মেয়াদ। আসলে এরকমই একটা ধারা চলছে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং প্রশাসনে। আর চলছে বলেই মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার, একদা মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকা সত্ত্বেও, অধিকাংশ মিডিয়াকর্মীর প্রতিবাদের মুখেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করাতে পারাকে নিজের সৌভাগ্য হিসাবে বিবেচনা করতে পারেন। প্রতিবাদ যা এসেছে তার বেশিরভাগই এসেছে সাংবাদিকদের কাছ থেকে। কিন্তু এর কুফল কিন্তু ভোগ করছে সকল মানুষই। এমনকি ভালুকার অজপাড়াগাঁ, হবিরবাড়ি এলাকার স্কুল ছাত্র কিশোর ইমন, সেও টের পেয়ে গেছে এই আইনেরতাপ।

কিশোর সংশোধনাগারে বসে নবম শ্রেণির এই ছাত্রটি হয়তো এখন ভাবছে- কই, এরকম একটা আইন যে আছে সে কথা তার শিক্ষকরা কখনো তো তাকে জানায়নি। তাদের পাঠ্য বইয়েও কিছু বলা নেই এ সম্পর্কে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে সে ফেসবুকে কিছু মন্তব্য করেছে, পরে আবার বুঝতেও পেরেছে- এসব লেখা ঠিক হয়নি, তখন দুঃখ প্রকাশ করেছে, তারপরও তাকে গ্রেপ্তার করা হলো! আচ্ছা, যে কথাগুলো ইমন লিখেছে, সেগুলো সে পেল কোথায়? তার মাথায় কথাগুলো কে ঢুকালো? কথাগুলো সে হয়তো কোথাও শুনেছে, হয়তো বাড়ির পাশে চায়ের দোকানের আড্ডায় শুনেছে, হয়তো দৌড়ের উপর থাকা কোন বিরোধী দলীয় কর্মীর কণ্ঠে শুনেছে, কিংবা এমনকি অর্থনৈতিক টানাপড়েনে নাজেহাল তার পরিবারের কর্তাব্যক্তির ক্ষুব্ধ উচ্চারণে শুনেছে।

শোনা সেই কথা সে কেবল তার ফেসবুকে রিপিট করেছে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ১৪ বছর ইমন এখন শিশুই একজন। সেই শিশুকে গভীর রাতে যেয়ে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে আনতে হলো! কত পাওয়ারফুল এই আইন! শিশুর কথা থাক, এবার বরং দুই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষকের কথা বলি। এই দুই শিক্ষকের একজন আবার আওয়ামী লীগ করেন। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম মারা যাওয়ার পর এরাও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সে কারণে তাদের বিরুদ্ধে মামলা, প্রথমে মামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা, পরে অ্যাকশনে গেছে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আর মামলা যেহেতু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে, মহাউৎসাহে পুলিশ যেয়ে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসেছে।

এ ধরনের মামলা আর গ্রেপ্তার প্রতিনিয়তই হচ্ছে। কোনটা কারণে হচ্ছে, কোনটা বা অকারণেই হচ্ছে। নানা ছুতা নাতায় হচ্ছে। আইনের অনেক ধারার মধ্যে থেকে দুটি মাত্র ধারা, ২৫ এবং ৩১, বরং এখানে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়। এই দুটি ধারা কথা বললাম এ কারণে যে, এরই মধ্যে গত জানুয়ারিতে এই দুটি ধারার বিষয়ে হাইকোর্টে আপত্তি উঠেছে। এই ধারাগুলো কেন আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়- সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে উচ্চ আদালত সরকারকে শোকজ করেছে। কয়েক বছর হয়ে গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে কোন উত্তর যায়নি। সরকার কি উচ্চ আদালতকে পাত্তা দেয়নি, নাকি বলার মত কোন যুক্তি তার নেই- তা অবশ্য জানা যায়নি।

কিন্তু কি আছে ওই ধারা দুটিতে? ২৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে-‘আপনার লেখায় যদি কোন ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় করার অভিপ্রায় প্রকাশ পায়, তাহলে আপনি অপরাধী।’ এখন আপনার যে কোন লেখায় আমি অপমানিত বোধ করতে পারি, বিরক্ত হতে পারি। অর্থাৎ বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয়- বিষয়গুলো কিন্তু‘ লেখার উপর নির্ভর করছে না, নির্ভর করছে যিনি লেখাটা পড়ছেন তার মানসিক অবস্থার ওপর।

 

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category

এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়