(হাত বাড়ালেই তোকে ছুঁই : ‘দে, দে, টান দে। আরে বেটা সিগারেট না খেলে কী আর হিরো হওয়া যায়? আজকাল তো মেয়েরাও পছন্দ করে না।’ নিজের হিরোইজম দেখাতে বন্ধুর সেই বাজে প্রস্তাবে সায় দেয় ভদ্র ছেলেটিও। শুরুটা হয় এভাবেই। অনেকেই আবার ধীরে ধীরে মাদকের নীল গণ্ডিতেও পা রাখে। তাই ধূমপানকে মাদকের প্রবেশদ্বার বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।)
শের ই গুল :
বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে উন্নয়নযজ্ঞে গা ভাসিয়েছে মানুষ, জীবন হয়েছে সুখকর ও আনন্দময়। আবার এই আধুনিক সভ্যতা সমাজে তৈরি করেছে এক অমোঘ শূন্যতা- সাধ ও সাধ্যের মধ্যে ফারাক; জীবনের প্রতিক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা, টিকে থাকার জন্য শুধুই ছুটে চলা। যৌথ পরিবার ভেঙে ঘরে ঘরে আজ পৃথক থাকার সংস্কৃতি; সুখ-দুঃখ ভাগ করার মতো আপন কেউ নেই। পরতে পরতেই যেন সামাজিক অবক্ষয়, হারাতে বসেছে মানবিক মূল্যবোধ, শিক্ষাব্যবস্থাও লক্ষ্যহীন, আছে কর্মসংস্থানের অভাব।
সব মিলিয়েই জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে কয়েকটি শব্দ- বিষণ্ণতা, হতাশা, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব। এর সুযোগে সক্রিয় গোপন দুষ্টচক্র, যুবসমাজের হাতে তুলে দিচ্ছে মরণনেশা মাদক। এ যেন এক গভীর চক্রান্ত। এ নেশা কেবল ব্যক্তির সম্ভাবনাময় জীবনকেই ধ্বংস করছে না; গ্রাস করে নিতে চায় পরিবার, সমাজ তথা পুরো জাতিকেই। কোথাও একমাত্র সন্তানের একাকিত্বই কারণ, কোথাও আবার অঢেল টাকার জোগান। এমনো উদাহরণ রয়েছে, বাবা-মায়ের চাপে ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন যুবকটি; কিন্তু স্বপ্নপূরণ না হওয়ায় মানসিক অবসাদ থেকেই মাদকে বুঁদ হয়ে যাওয়া। কোনো কোনো ঘটনা এমনো আছে, যেখানে স্রেফ কৌতূহল থেকেই শুরু এ অন্ধকার যাত্রায়।
কারও বন্ধুরা নেশায় উৎসাহ দিয়েছেন, কারও কেবল সতর্ক করেই দায় সেরেছেন। আর এভাবেই উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সঙ্গী হয়েছে মাদক। হাত বাড়ালেই তোকে ছুঁই : ‘দে, দে, টান দে। আরে বেটা সিগারেট না খেলে কী আর হিরো হওয়া যায়? আজকাল তো মেয়েরাও পছন্দ করে না।’ নিজের হিরোইজম দেখাতে বন্ধুর সেই বাজে প্রস্তাবে সায় দেয় ভদ্র ছেলেটিও। শুরুটা হয় এভাবেই। অনেকেই আবার ধীরে ধীরে মাদকের নীল গণ্ডিতেও পা রাখে। তাই ধূমপানকে মাদকের প্রবেশদ্বার বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও আড়ালে-আবডালে নিত্যই বসে তাদের আসর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে, বিভিন্ন দেশে লেখাপড়া করতে গিয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ মাদকাসক্ত হচ্ছে। পরিচিত হচ্ছে নিত্যনতুন সব মাদকের সঙ্গে। দেশে ফেরার সে সময় বিভিন্ন কৌশলে সব মাদক দেশে এনে সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। চাহিদা তৈরি হওয়ায় অন্য পথেও তা দেশে এনে ব্যবসা করছে অনেকে। করোনাকালে মূলত উন্নত দেশগুলো থেকে এসব মাদক আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশে আসছে। লালমাটিয়া ও ধানমন্ডি থেকে গেল মে মাসেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তিন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ২০০ ব্লট এলএসডি পাওয়া যায়।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তাদেরই একজন জানান, তিনি টেলিগ্রাম অ্যাপে যোগাযোগ করে ‘টিম’ নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে নেদারল্যান্ডস থেকে এই মাদক আনিয়েছেন। সে জন্য প্রতি ব্লটে খরচ হয়েছে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ওই মাদক দেশে এসেছে। আর সেগুলো বিক্রি হতো দুটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে। পাতা ফাঁদে পা বাড়াচ্ছে তরুণীরাও : একটা সময় ছিল, যখন প্রেমিকার কাছে ভালোবাসার জন্য সিগারেট ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হতো একটি ছেলেকে। আজ পুরোটাই উল্টো- দুই ঠোঁটের মাঝে আলতো করে ধরে লম্বা টান। একরাশ ধোঁয়ার রিং হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ষোড়শী মেয়েটি তার ছেলে বন্ধুটিকে বলে উঠে- ‘কেমন দিলাম? একেই বলে টান।
মাস কয়েক আগেই রাজধানীর উত্তরায় ‘ব্যাম্বো স্যুটস রেস্টুরেন্টে’ অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ফারাহ চৌধুরী। পরে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
পুলিশ জানায়, বন্ধুদের প্ররোচনায় মদ পার্টিতে গিয়ে অতিরিক্ত মদ্যপানে বমি এবং পরে ধর্ষণের শিকার হন মেয়েটি। ওই ঘটনায় পুলিশ তার অভিযুক্ত বন্ধুদের গ্রেপ্তারও করে। ব্যাম্বো স্যুটসে গভীর রাত পর্যন্ত ধর্ণাঢ্য পরিবারের ছেলে-মেয়েরা মদের পার্টিতে মগ্ন থাকত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. লীমা হক বলেন, ‘শহরের অনেক মেয়েই এখন ধূমপান কিংবা মাদকে আসক্ত।
সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের কাছে এটাই যেন স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক মেয়ের কাছে আবার অতি আধুনিকতার নামে এক ধরনের ফ্যাশনের ভাব কাজ করে। পাশাপাশি নগরজীবনের তীব্র প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া অনেকেই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না। তাদের মধ্যে তৈরি হয় এক ধরনের হতাশা। তখন অনেকেই মাদক ও ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে বেচাকেনা : বাবা ব্যবসায়ী, মা মানসিক সমস্যায়- স্কুলের বাইরে সারাক্ষণ ঘরবন্দি থেকে বিতৃষ্ণ হয়ে পড়ে তাদের একমাত্র মেয়ে মৌ (ছদ্মনাম)। একাকিত্বতা কাটাতে বন্ধুদের কুপরামর্শে স্কুলে পড়া অবস্থাতেই সঙ্গী হয় ঘুমের ওষুধ। এরপর অনলাইন গেমে আসক্তি।
ফেসবুক গ্রুপ করে চলে আড্ডা, সুযোগ পেলে ছেলেবন্ধু এবং মদ-বিয়ারের পার্টি। এর সুবাধে অল্প বয়সেই প্রেম-বিরহের স্বাদ। মৌকে নিয়ে দিশেহারা বাবা। উপায়ান্ত না পেয়ে ভর্তি করানো হয় একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে। তার সঙ্গে কথা বলেই জানা যায়, মূলত ‘অভিজ্ঞ’ নেশাগ্রস্তদের হাত ধরেই আসে ‘শিক্ষানবিসেরা’।
কার কাছে কোন মাদক আছে, তার খোঁজ রাখতে তৈরি হয় অনলাইন গ্রুপও। একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের এক সদস্যের কাছ থেকে জানা যায়, তাদের গ্রুপের মাধ্যমে হেরোইন, কোকেন, এন-১০, ব্রাউন সুগার, কোরেক্স, মারিজুয়ানা, বারবিচুয়েট, ম্যানডেক্স, এলএসডি, ডিএমটি, ম্যাজিক মাশরুম, ব্রাউনি বা গাঁজার কেক, ইয়াবা- সব ধরনের মাদকেরই বেচাকেনা চলে। যারা খুব বিশ্বাসযোগ্য, শুধুমাত্র তাদেরই ওই গ্রুপের সদস্য করা হয়। মাদক বিক্রির আখড়া ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ‘বাজার’। কোথায়, কত দামে কী মিলছে, তা গ্রুপের মাধ্যমেই জেনে যান মাদকাসক্তেরা।
তিনি আরও জানান, এমন বেশিরভাগ গ্রুপই পরিচালনা করা হয় প্রক্সি সার্ভারের মাধ্যমে। কোনো গ্রুপ আবার দেশের বাইরে থেকে চালানো হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতেই এমন নানা কৌশল। আর প্রতিটি মাদকের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় সাংকেতিক নাম। কোনো কোনো গ্রুপে মাদকের কোড নম্বর ব্যবহার হয়। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিকে ভয়ংকর মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা মেথামফেটামাইনসহ এক নাইজেরিয়ানকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ দপ্তর। তাদের ভাষ্য, নিষিদ্ধ ডার্ক নেটের সদস্য হয়ে ওই ব্যক্তি আফ্রিকা থেকে এসব মাদক এনে বিক্রি করতেন। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ আফ্রিকা বা নাইজিরিয়া থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীরাও অনেক সময় টাকার লোভে মাদক পাচারের কাজে জড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ পুলিশের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দিলীপ কুমার সাহা বলেন, ‘ঢাকায় ডিএমডি নামক মাদক ধরা পড়ে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বিদেশ প্রত্যাগত ধনীর দুলালেরা ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানদের কাছে এ ধরনের মাদক বিক্রি করে। নতুন এই নেশাদ্রব্যটি মূলত হ্যালুসিনোজেনস গ্রুপের একটি মাদক। মস্তিষ্কের ইন্দ্রিয়কে প্রভাবিত করতে এবং হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি তথা দেখা, শ্রবণ, গন্ধ, স্বাদ বা অস্তিত্ব নেই, এমন জিনিসগুলোকে তা অলীকভাবে স্পর্শ করে। এভাবে তারা কল্পনার জগতে প্রবেশ করে।
আর রাসায়নিক দিক থেকে ডিএমটি হলো এনএন ডাইমিথাইলট্রিপটামিন, যা বিভিন্ন গাছপালা ও প্রাণীর মধ্যে পাওয়া যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্তের সূত্র ধরে নতুন করে আলোচনায় আসে লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড, যা বিশ্বে পরিচিত এলএসডি হিসেবে। সাধারণভাবে এলএসডি বর্ণ ও গন্ধহীন। ব্লটার কাগজ, চিনির কিউব বা জেলটিনের আকারে এ মাদক বিক্রি করা হয়। গবেষণায় এর আসক্তি তৈরির কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে এ মাদক মস্তিষ্কের ক্রিয়ার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। তাতে উদ্বেগ, প্যারানয়া কিংবা বিভ্রম ঘটার মতো পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : ঢাকা আহছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্ত ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রধান উম্মে জান্নাত বলেন, ‘বর্তমান সময়ে শিশুদের (আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে) মধ্যে ইয়াবা গ্রহণের প্রবণতা উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। এরা ফেসবুক, টিকটক, লাইকি থেকে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপে গিয়ে লাইভ চ্যাট করে। ওইসব গ্রুপে ঘাপটি মেরে থাকা চক্র তাদের জন্য মদ, ইয়াবা, সিসাবারে পার্টির আয়োজন করে থাকে। এমনকি মাদকের হোম ডেলিভারিও দেওয়া হচ্ছে এখন। গ্রুপের ১৪ থেকে ১৫ বছরের সদস্যরা প্রেম থেকে অনৈতিক কাজেও জড়িয়ে পড়ছে। আমাদের এখানে আসা এমন শিশু-কিশোরীকে মনোচিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোসাম্মদ নূরজাহান খাতুন বলেন, ‘কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মাদক গ্রহণ বা কারবারের পেছনে অন্যতম কারণ সামাজিক অবক্ষয়। সমাজে নিত্য নতুন অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টি হলেও, সেভাবে প্রতিরোধ সম্ভব হয় না; কিন্তু আমাদের দেশে বড় সমস্যা মাদক নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করলেও অনেক সময় তাদের সদস্যদের বিরুদ্ধেই পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ আসে।
তিনি আরও বলেন, ‘মাদকের সহজলভ্যতা বন্ধ হলেই সেবন বা কারবার কমবে। এতে নতুন নতুন আইনের দরকার নেই। শিশু-কিশোরদের মধ্যে ক্ষুদ্র একটা অংশ সেবন করে কিন্তু গডফাদার তো এরা নয়। উৎসে গিয়ে মূল অপরাধীদের দমন করতে পারলে মাদকের মতো শিশু-কিশোর নির্ভর অন্যান্য অপরাধগুলোও নিয়ন্ত্রণে আসবে।
এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়
Leave a Reply