(খুচরা বিক্রেতা এবং মাদক সেবনকারী সহ দেশে অর্ধ কোটি পুরুষ ও মহিলা এই মরণঘাতী মাদকের সাথে জড়িয়ে আছে কোন না কোনভাবে। আন্তর্জাতিক মাদক কু-চক্রী মহলের ব্যবসার টার্নিং পয়েন্টে রয়েছে বাংলাদেশ। তারা গডফাদারদের সহায়তায় ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত থেকে মাদক সংগ্রহ করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।)
মোঃ জসিম উদ্দিন :
গত কয়েক বছর আগে সারাদেশে তিন হাজার মাদক কারবারির তালিকা তৈরি করেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। বর্তমানে এই ব্যবসায় দ্রুত বড় লোক হওয়া যায় এমন ভাবনা থেকে মাদক সেবনকারীরা নিজেরাই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে বনে গেছেন মাদক ব্যবসার গড ফাদার।
সারাদেশে বিভিন্ন থানা থেকে প্রাপ্ত সংবাদ এবং গণমাধ্যমের বরাতে এই মাদক গড ফাদারের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় তিন লাখ ছুইছুই। মাদক পাচারের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাসহ বিভিন্ন অসাধু প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ এ তালিকায় উঠে এসেছে লক্ষ লক্ষ গডফাদারের নাম। করা হয়েছে ৬৪ জেলার মাদককারবারীদের শর্ট তালিকাও। অধিদপ্তর থেকে এই তালিকা ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। যদিও ডিএনসির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য ইউনিটও পৃথকভাবে তালিকা তৈরি করে থাকে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ তালিকার সঙ্গে অন্যান্য ইউনিটের তালিকার সমন্বয় করে মাদকবিরোধী অভিযান চলমান থাকবে। ডিএনসি সূত্র জানায়, চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে গতি বাড়াতে নানামুখী তৎপরতা চালানো হচ্ছে। কৌশল অবলম্বন ও বারবার নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করায় মাদক কারবারিদের গ্রেপ্তারে বেগ পেতে হচ্ছে। ক্রস ফায়ার এবং গ্রেফতার সহ ব্যাপক অভিযানের জন্য মাদককারবারীরা কিছুটা দমে গিয়ে নতুন আঙ্গিকে নিত্য মাদক চোরাচালানের রুট পরিবর্তন করে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের সাথে আতাত করে। দেশের ৬৪ জেলার পাড়া-মহল্লায় মাদক ব্যবসা সচল রেখেছে এই প্রায় তিন লাখ মাদক ব্যবসায়ী।
এদের মধ্যে বেশিরভাগই পাইকার। খুচরা বিক্রেতা এবং মাদক সেবনকারী সহ দেশে প্রায় ৫০ লক্ষের বেশি পুরুষ ও মহিলা এই মরণঘাতী মাদকের সাথে জড়িয়ে আছে কোন না কোনভাবে। আন্তর্জাতিক মাদক কু-চক্রী মহলের ব্যবসার টার্নিং পয়েন্টে রেখেছে বাংলাদেশকে। তারা গডফাদারদের সহায়তায় ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত থেকে মাদক সংগ্রহ করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সক্রিয় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স) প্রাণের বাংলাদেশকে বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা করা অধিদপ্তরের রুটিন কাজ। কয়েকমাস পর পর এই তালিকা নবায়ন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। তালিকায় নাম থাকা কেউ গ্রেপ্তার হলে বা মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিলে তার নাম বাদ দেয়া হয়।
পরে আপডেট তালিকা নিয়ে ওই ব্যবসায়ী বা চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এখানে কাউকে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বর্তমানে সক্রিয় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর কামাল হোসেন ও শামীম, রাজধানীর উত্তরার দলিপাড়ার ডেঙ্গু, ১৪ নং মাজারের হানিফ মেম্বার, দিয়াবাড়ীর বাবু, বাউনিয়ার রজনী, দলিপাড়ার আরিফ, উত্তরার পলি, দলিপাড়ার মিলন, নড়াইলের মিলন-স্ত্রী চম্পা, উত্তরার জ্যোৎস্না, আব্দুল্লাহপুর কোটবাড়ী হাসান-স্ত্রী লাকি, ফুলবাড়ীয়ার রানা, ১৫ নং বালুর মাঠের কালামের রিক্সা গ্যারেজের রফিক, দিয়াবাড়ীর বিআরটিএ’র পাশে রিক্সা মালিক কালামের ছোট ভাই আলম, রামপুরার রজব, রিমা, কামারপাড়ার হিরা, উত্তরা হাউজ বিল্ডিং হোসের মার্কেটের ৪র্থ তালার রয়েল ব্লু হোটেলের সাজ্জাদ, টঙ্গীর সানি, উত্তরার দক্ষিণখান কাঠালতলা এলাকার আমতলার কামরুল, বাংলাদেশ মেডিকেলের পিছনে তন্ময়, দক্ষিণখানের বাবু, উত্তরায় বরিশাল্ল্যার ইয়াবা বাবু, ৬ নং সেক্টরের জালাল, ৫ নং সেক্টর লেকপাড় সুমি তালুকদার, ১৪ নং সেক্টরের লিজা/রিপন, দক্ষিণখান মুজিবর মার্কেটের মাসুদ রানা, ফায়দাবাদ মিজানের রিক্সা গ্যারেজ লাইলি ও শিল্পী। উত্তরখানে রেবা, সুন্দরী, কেরু সাব্বির, মামুন।
আজমপুর কাঁচা বাজারের রতন, মিজানের গ্যারেজের নাজমুল, উত্তরা পাসপোর্ট অফিসের পশ্চিম পাশে আফজা ও তার স্বামী, গাজীপুর টঙ্গী ব্যাংকের মাঠের আর্জিনা, এরশাদ নগরের ওলির মেয়ে শারমিন, মাজার পট্টি লাইলী, কেরানীরটেকে রহিমা, মুন্সীগঞ্জের রিয়াদ উল্লাহর নিয়ন্ত্রণে চলে বাড্ডা এলাকার ১০-১২টি স্পট। কক্সবাজারের সাব্বির হোসেনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ভাটারার ইয়াবা সিন্ডিকেট। পুলিশ-র্যাবের তালিকায় রয়েছে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী সাব্বিরের নাম।
এছাড়াও তালিকাভুক্ত ঢাকার ৩৭ গডফাদারের মধ্যে রয়েছে- উত্তরায় গোলাম সামদানি, বংশালে নাসির উদ্দিন, মুগদায় পারভীন, শফিকুল ইসলাম মলাই, রাজু আহমেদ ও আলম হোসেন, কমলাপুরে লিটন, চকবাজারে ওমর ফারুক, লালমিয়া, কলাবাগানে নাজমুস সাকিব ভুইয়া, শামিম, কামরাঙ্গীরচরে খুরশিদা ওরফে খুশি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগে শহিদুজ্জামান, চাঁনখারপুলে পারভিন আক্তার, আসমা আহমেদ ও নারায়ণগঞ্জের ছেলে কামাল হোসেন, যাত্রাবাড়ীতে মোবারক, গেণ্ডারিয়া এলাকায় রহিম ও মিরপুর চলন্তিকা বস্তি এলাকায় নজরুল। তালিকাভুক্ত গডফাদারদের প্রত্যেকের ইয়াবা ব্যবসা রয়েছে। আবার অনেকের হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ একাধিক মাদকের কারবার রয়েছে।
গাজীপুরের আরিফ সরকার ও মহসিন মিয়া ওরফে ইকবাল হোসেন খান, নারায়ণগঞ্জের রাসেল ও রনি কাজী, মুন্সীগঞ্জের রিপন শেখ ও আমেনা বেগম, নরসিংদীর হানিফ ও রবিউল ইসলাম রবি, মোবারক, টাঙ্গাইলের রাসেল ও সুচরিতা, রাজবাড়ীর বৃষ্টি আক্তার ও আলমগীর বেপারি, মানিকগঞ্জের আরজু ও পাখি মিয়া, শরীয়তপুরের লোকমান বেপারি ও জহির, মাদারীপুরের বাবুল সরদার ও রেজাউল হাওলাদার, কিশোরগঞ্জের সুমি ও রুবেল মিয়া, গোপালগঞ্জের সোনা মিয়া ও লাল চান ফকির, ফরিদপুরের প্রিন্স মাহমুদ ও দক্ষিণ চর কমলাপুরের লিয়াকত শিকদার, চট্টগ্রামের আজিজুল হক ওরফে জুলাইক্যা ও আমজু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রহিম মিয়া ও মোবারক আলি, চাঁদপুরের হাবিব মোল্লা ও সোহেল ওরফে কাটলি সোহেল, কুমিল্লার নুরুল হক ও রবিন, কক্সবাজারের শাহজাহান আনছারী ও রশিদ আনছারী, খাগড়াছড়ির তপন দে ও সাজু আহমেদ, লক্ষ্মীপুরের আলি হোসেন ও মনির হোসেন, নোয়াখালীর নুর আলম রাজু ও নিজাম উদ্দিন, ফেনীর রসুল আহম্মদ বলী ও রায়হান উদ্দিন আহম্মদ ওরফে রিয়াদ, রাঙ্গামাটির বাদশা আলম ও মঞ্জুরা বেগম, বান্দরবানের ওয়েমং মারমা ও মিদু অং মারমা, রাজশাহীর বজলুর করিম ওরফে বজলু ও মিন্টু, বগুড়ার টোকেন ও শান্ত মিয়া, পাবনার কালা সাদ্দাম ও রমজান, জয়পুরহাটের ফারুক হোসেন ও জমিরউদ্দিন, সিরাজগঞ্জের শরীফ ও আলি আশরাফ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের টিপু সুলতান ও হোসেন আলি, নওগাঁর মিঠু ও শ্রী সুজন, নাটোরের মাসুম ও তৌহিদুল ইসলাম ডলার, খুলনার মমিন গাজী ও টেরা খোকন, বাগেরহাটের সেকান্দার ও খোকন, চুয়াগাঙ্গার তানজিল ও আমজাদ, যশোরের আমির হোসেন ও লোকমান হোসেন,ঝিনাইদহের শহীদুল ইসলাম ও সাইদুল ইসলাম, কুষ্টিয়ার রাজু আহম্মেদ ও সাজ্জাদ হোসেন, মাগুড়ার নজরুল ইসলাম বুধো ও শাহিনুল, মেহেরপুরের আজিজুল ইসলাম ও আবদুল কাশেম, নড়াইলের বাদশা মোল্যা ও ফিরোজ শেখ, সাতক্ষীরার নজরুল ইসলাম ওরফে বরনু ও আজিজুল ইসলাম, রংপুরের টিপু সুলতান ও পারভীন, দিনাজপুরের শাহজালাল ও মোমিনুর, গাইবান্ধার শাহানুল ইসলাম শাওন ও সুজন চৌধুরী, কুড়িগ্রামের আনিস ওরফে আনাস ও শ্রী মানিক চন্দ্র, লালমনিরহাটের রবিউল ইসলাম ও মমী বেগম, নীলফামারীর একরামুল ও নাদিম, পঞ্চগড়ের হাবুল ওরফে হাবলু ও শ্রী সুমন বাশফোড়, ঠাকুরগাঁওয়ের কলাডাঙ্গীর জহিরুল ইসলাম ও শিতলপুরের জহিরুল ইসলাম, সিলেটের আনোয়ার হোসেন ও আনোয়ার মিয়া, হবিগঞ্জের জসিম উদ্দিন ও রশিদ মিয়া, সুনামগঞ্জের শামছুল হক ও মামুনুর রশিদ, মৌলভিবাজারের শামীম মিয়া ও ইসমত মিয়া, বরিশালের বাবুল হোসেন ও সোহেল আবদুল্লাহ, বরগুনার রশিদ মৃধা ও আফজাল হোসেন, বামনার মুসা, ভোলার মুন্না ও নিলয়, ঝালকাঠির স্বপন ও রাজ্জাক, পটুয়াখালীর শাইন খান ও সাইফুল খান, পিরোজপুরের আবির শেখ প্রিন্স ও বাপ্পি শেখ, ময়মনসিংহের মজিবর ও শাওন, জামালপুরের আশরাফুল ইসলাম নাহিদ (রকি) ও আয়াত আলি, নেত্রকোনার সেলিম মিয়া ও রুমন খান পাঠান এবং শেরপুরের শেখ ফরিদ ও আবদুল মোতালেব।
এদিকে, একসময় কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবার চালান দেশে আসলেও এখন ভারতীয় সীমান্তই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ভরসা। ভারতীয় মাদকের গডফাদাররা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা কিনে বাংলাদেশে পাচার করছে। ইতোমধ্যে ভারতীয় ওই গডফাদারদের তালিকাও করেছে বাংলাদেশ। গত ১০ অক্টোবর রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বাংলাদেশ ভারত মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পর্যায়ের এক বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে বেশ কয়েকজন ভারতীয় মাদক গডফাদারের তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে।
এছাড়া শুধু একটি কোম্পানির ফেনসিডিল বাংলাদেশে আসায় সে বিষয়টিও অবগত করেছে বাংলাদেশ। শুধু মাদক অধিদপ্তরই নয় সারাদেশে এখনো কারা মাদক ব্যবসা করছে তার তালিকা নবায়ন করছে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ড। বিভিন্ন কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা এসব ব্যবসায়ীদের ধরতে শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে। যত প্রভাবশালীই হোক কাউকেই মাদক ব্যবসা করতে দেয়া হবে না বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র।
উল্লেখ্য, মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষা করতে গত বছরের মে মাসে সারাদেশে শুরু হয় মাদকবিরোধী অভিযান। গ্রেপ্তার করা হয় দেড় লক্ষাধিক মাদক কারবারিকে। র্যাব ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় প্রায় ৪০০ মাদক ব্যবসায়ী। ১০২ মাদক ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণের পর প্রাণের ভয়ে গা ঢাকা দেয় অনেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি মাদকবিরোধী অভিযান ঝিমিয়ে পড়ায় থমকে যাওয়া মাদক ব্যবসা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। মাদকের ঢল থামাতে সাড়াশি অভিযান আবার জোড়দার করতে হবে।
Leave a Reply