(সাইনবোর্ড সাংবাদিক, আইডিকার্ড সাংবাদিক, ভুয়া সাংবাদিক, প্রেসক্লাব সাংবাদিক, ঘুরাঘুরি সাংবাদিক, ফেসবুক সাংবাদিক, বহুমাত্রিক সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক, দলীয় সাংবাদিক, ভবিষ্যতদ্রষ্টা সাংবাদিক, মৌসুমী সাংবাদিক, শখের সাংবাদিক, অপসাংবাদিক, স্বার্থপর সাংবাদিক, বঞ্চিত সাংবাদিক, লাঞ্ছিত সাংবাদিক, কাঙ্খিত সাংবাদিক।)
প্রাণের বাংলাদেশ ডেস্ক :
সকল পেশাতেই ভাল খারাপ মানুষ আছে। পুলিশে যেমন ভাল পুলিশ এবং খারাপ পুলিশ আছে, চিকিৎসকদের মধ্যে যেমন ভাল ও খারাপ দুই প্রকারই আছে, শিক্ষক, এমনকি দোকানদারের মধ্যেও যদি প্রকারভেদ থাকতে পারে, তবে সাংবাদিকদের মধ্যেও ভাল ও খারাপ, সাদা এবং কালো, এমন ভিন্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক ঘটনা এবং বাংলাদেশে এটা আছেও।
আজকে কথা বলব সেই সব প্রকরণ নিয়ে, যেটা বিশ্ব মিডিয়ায় নেই, অথচ আছে আমাদের দেশে। এখানেই আমরা স্বকীয়-স্বতন্ত্র-গৌরবান্বিত! বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিক কত প্রকার ও কি কি : ১. সাইনবোর্ড সাংবাদিক, ২. আইডিকার্ড সাংবাদিক, ৩. ভুয়া সাংবাদিক, ৪. প্রেসক্লাব সাংবাদিক, ৫. বহুমাত্রিক সাংবাদিক, ৬. কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক, ৭. দলীয় সাংবাদিক, ৮. ভবিষ্যতদ্রষ্টা সাংবাদিক, ৯. মৌসুমী সাংবাদিক, ১০. শখের সাংবাদিক, ১১. অপসাংবাদিক, ১২. স্বার্থপর সাংবাদিক, ১৩. বঞ্চিত সাংবাদিক, ১৪. লাঞ্ছিত সাংবাদিক, ১৫. কাঙ্খিত সাংবাদিক, ১৬, ঘুরাঘুরি সাংবাদিক, ১৭. ফেসবুক সাংবাদিক,
১. সাইনবোর্ড সাংবাদিক : সাধারন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা কিংবা জিম্মি করে টাকা আদায়ই তাদের পেশা। এরা অনেককে সাংবাদিক বানিয়ে দেওয়ার কথা বলে অর্থকড়ি নেয়। মতিঝিল পাড়ায় এদের সাইনবোর্ড সমৃদ্ধ ছোটখাট অফিসের দেখা মেলে।
২. আইডিকার্ড সাংবাদিক : এরাও সাইনবোর্ডধারী সাংবাদিকদের মতোই। তবে এদের মিডিয়ার নিবন্ধন থাকে। কিন্তু তাদের প্রচার খুবই কম। কাউকে ভয় দেখানোর জন্য এরা হুটহাট এফবিআই স্টাইলে নিজের ‘আইডি কার্ড’ বের করে সামনে ধরে। ৩. ভুয়া সাংবাদিক : সাংবাদিক না, অথচ সাংবাদিকের ভুয়া আইডি গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় এরা। চাঁদাবাজি থেকে তদবির বাণিজ্য- সবই করে। এমনকি ধরা পড়লে তারা গণপিটুনি খাওয়ার জন্যও তৈরি থাকে।
৪. প্রেসক্লাব সাংবাদিক : সাংবাদিকতা নয়; এরা পারলে দিনের ২৪ ঘন্টাই প্রেসক্লাবে পড়ে থাকে। প্রেসক্লাবই তাদের ঘরবাড়ি-তীর্থস্থান। কোনো কাজ নেই, কোনো কর্ম নেই। শুধুই আড্ডাবাজি, চা-বাজি, রাষ্ট্র উদ্ধারসহ দেশ-বিদেশের বিবিধ কর্ম নিয়ে এরা দিনমান গুজার করে। অনেকের দলীয় সংযোগ থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি খোয়ানোর ঝামেলা হয় না। অনেকের আবার মিডিয়া প্রতিষ্ঠানও নেই! এদের ইনকাম চলে বিভিন্ন অপরাধীদের থেকে মাসিক মাসোয়ারা নিয়ে।
৫. বহুমাত্রিক সাংবাদিক : এরা বহুমাত্রিক প্রতিভাধর সাংবাদিক! এদের আইডি কার্ড ও ভিজিটিং কার্ডে একাধারে অনেকগুলো পরিচয় লিপিবদ্ধ থাকে। যেমন: সাংবাদিক, রাজনীতিক, কবি, ডাক্তার, আইনজীবী প্রভৃতি। এ যুগে যদি অ্যারিস্টটল, প্ল্যাটো কিংবা সক্রেটিসরা বেঁচে থাকতেন, এই বহুমাত্রিক প্রতিভাধর সাংবাদিকদের জ্ঞানগরিমা দেখে তারা আত্মহত্যা করতেন।
৬. কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক : কোনো কোনো পত্রিকা হাউসে এমনও রিপোর্টার আছেন, যাদেরকে খোদ সাংবাদিকরাই কথাসাহিত্যিক বলে ডাকেন। এই কথাসাহিত্যিক কিন্তু সাহিত্যের কথাসাহিত্যিক নয়। তবে তাদের কাজটা অনেকটা সে রকমই। সংবাদের অভাবে পত্রিকার পাতা ভরানোর সংকট সৃষ্টি হলে তারা সম্পাদক কিংবা বার্তা সম্পাদকদের নির্দেশে রাজনৈতিক বা নানা অপরাধমূলক ঘটনার ফলোআপ কল্পকাহিনী রচনা করেন। আবার মালিকপক্ষের ফরমায়েশি কল্পকাহিনী লেখার কাজেও এই ধারার সাংবাদিকতার জুড়ি মেলা ভাড়। এই শ্রেণিটা অনেকটা সম্পাদকের মেরুদণ্ডহীনতা ও সততার অভাবজনিত কারণে সৃষ্টি হয়।
৭. দলীয় সাংবাদিক : এই সাংবাদিকরা সবচেয়ে বড় তেলবাজ। নেতা বিশ্বের সেরা দুশ্চরিত্র হলেও তাদের পা চাটতে এরা খুব পটু। এরা উপরে উপরে সক্রিয় রাজনীতি করে না। ভেতরে এরা দলীয় নেতাকর্মীদের চেয়েও বড় রাজনীতিক। সাংবাদিকতা তাদের তৃতীয় পেশা। দুষ্টু লোকেরা এদেরকেই বেশিরভাগ সময় সাংঘাতিক নামে আখ্যা দেয়। এদের অনেকেই রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মতো ডিগবাজি দিয়ে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দলে ভীড়ে যায়। তবে সম্পাদক লেভেলের সাংবাদিকরা আরেক ধাপ এগিয়ে। তারা প্রকাশ্যে সরকারি দলে এবং গোপনে বিরোধী দলে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীর সাথে তোলা পুরানা ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে। অথচ ক্ষমতাহীন নেত্রীর সাথে ছবিগুলো পোস্ট করা থেকে বিরত থাকে।
৮. ভবিষ্যতদ্রষ্টা সাংবাদিক : সিডনী, টরন্টো, নিউইয়র্কে বসেই গুলশানে কে খুন হলো, কোন রঙের গাড়িতে খুনিরা পালালো, লাশ বস্তাবন্দি করে কোন নদীতে তারা ফেলল সবই এরা সুদুর প্রবাসে বসে থেকে শক্তিশালী একধরণের বাইনোকুলার দিয়ে দেখে ফেলে। অবশ্য তাদের ভবিষ্যবাণীর সিংহভাগই ভুল প্রমাণিত হয়।
৯. মৌসুমী সাংবাদিক : এরা সারা বছর সাংবাদিকতা করেন না; নির্বাচনের মৌসুম এলে, কিংবা এরকমের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো আয়োজন থাকলে পরে এরা হঠাৎ উড়ে এসে সাংবাদিকতায় নাম লেখান।
১০. শখের সাংবাদিক : অন্য পেশার লোক এরা। নিজের পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত, তারপরও সাংবাদিকতার সামাণ্য ধারণা ছাড়াই তারা এ পেশায় যুক্ত হয়। অথচ এই পেশায় তাদের আদৌ প্রয়োজনও নেই। এই পেশায় কি মধু আছে তারাই এটা ভাল বলতে পারবে।
১১. অপসাংবাদিক : নাম ঠিকানা লিখতে পারেনা, নিজের নামটি সই করতেও পারেনা, অথচ ভাবসাব এবং কথা বার্তায় কাউকে ছেড়ে দেয়না। সবসময় নিজেদের ক্ষমতা দেখায়। দলবল নিয়ে চলে। প্রয়োজনে কারোও গায়ে হাত দিতেও চিন্তা করেনা। একবার সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) উপনির্বাচনে ১৭৬ টি ভোট বাতিল হয়েছিল! এরা ঠিকমত টিক চিহ্নটিও দিতে পারেনি! এরা কলম চালাবে কীভাবে? অবস্থা দেখে তখন অনেকে বলেছিলেন, এরাই অপসাংবাদিক। এরাই এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সাংবাদিকতার মাঠ। জাতীয় প্রেসক্লাবকে এরা বানিয়েছে মাছের বাজার।
১২. স্বার্থপর সাংবাদিক : খুবই ডেঞ্জারাস প্রকৃতির সাংবাদিক এরা। নাম দেখেই বুঝা যাচ্ছে তাদের প্রকৃতি। এরা বন্ধুর বুকে ছুরি বসাতেও দ্বিধা করে না। নিজের চাকরি বাঁচাতে বা পোক্ত করতে এরা নিজের বন্ধুদেরকে হাউসচ্যুত করে।
১৩. বঞ্চিত সাংবাদিক : সংখ্যায় কম হলেও এরাই মূলত এখনো সাংবাদিকতার মহান আদর্শ ধরে রেখেছে। নীতি আর আদর্শ ধরে রাখার ফলে এদের শুভাকাঙ্খী কম। যার ফলশ্রুতিতে তারা সরকারি-বেসরকারি কোনো সহযোগিতা পায় না এবং তারা এটার ধারও ধারে না। প্রেসক্লাবের সদস্য পদ, কিংবা সরকারি প্লট-ফ্ল্যাটের আবেদন তারা করে না। এদের রাজনৈতিক অন্ধত্ব নেই। এরা নেপথ্যে সারাদিনমান নিজ নিজ মিডিয়ায় কাজ করে যায়। এরা মনে করে, সারাক্ষণ কাজ করলে এর প্রতিদান হয়তো মিলবে। কিন্তু তাদের সেই ধারণা শেষে মিথ্যে প্রমাণিত হয়।
১৪. লাঞ্ছিত সাংবাদিক : এই ঘরানার সাংবাদিকরা তাদের ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই কোনো প্রভাবশালী রাজনীতিক, সন্ত্রাসী কিংবা গোষ্ঠীর হুমকি-ধামকি, হামলা, লাঞ্ছনার শিকার হয়। এবং এটা দিনের পর দিন চলতেই থাকে। জীবনও যায় কারো কারো।
১৫. কাঙ্খিত সাংবাদিক : সুশিক্ষিত, সৎ, ন্যয়-নীতিবান, আদর্শ সাংবাদিকই কাঙ্খিত সাংবাদিক। সমাজে এই সাংবাদিকদেরই বেশি করে প্রয়োজন হলেও বর্তমানে এদের সংখ্যা বিরল। খাল-বিল-নদী নালায় দেশজ মাছ যেভাবে হারিয়ে গেছে, ঠিক সেভাবেই এই আদর্শ সাংবাদিক এখন বিলুপ্তপ্রায়। অথচ এরাই প্রকৃত তথ্য সেবাদাতা। সমাজ ও রাষ্ট্রের উপকার হয় তাদের দ্বারাই।
১৬. ঘুরাঘুরি সাংবাদিক : এই প্রকারের সাংবাদিকরা কিছুদিন পরপর পিকনিকের নামে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ভুয়া কার্ড বানিয়ে চাঁদাবাজি করে নিজেদের পকেট ভরে এবং কক্সবাজার সহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যায়। এদের আবার একাধিক নাম স্বর্বস্ব মেয়ে সাংবাদিক আছে। এদের কাজ নিজেদের ফেসবুক আইডিতে ছবি পোস্ট করা। আমরা এখন অমুক জায়গায় আছি।
১৭. ফেসবুক সাংবাদিক : নিজেদের লেখা একটি সংবাদ কোন দিন কোন পত্রিকায় দেখা যায়না, অথচ সে ফেসবুকে খুব সরব। কিছু বুঝুক আর না বুঝুক স্ট্যাটাস দিতে ভুল করেনা। এদের হাতে আবার একটি স্মার্ট ফোন এবং স্ট্যান্ড থাকে যা দিয়ে হরহামেশা খালি লাইভ চালায়।
এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়
Leave a Reply