(কোন সাংবাদিক আপনার প্রতিষ্ঠানে আসলে প্রথমে তাকে সাদা কাগজ দিবেন, তার নাম ঠিকানা- বাংলা ও ইংরেজীতে লেখার জন্য। যদি লিখতে পারে তাদের সাথে কথা বলেন, তাদেরকে তথ্য দিয়ে সহযোগীতা করেন। যদি ব্যর্থ হয়, তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করুন।)
শের ই গুল :
সাংবাদিকতা মহান পেশা। খবরের পিছনের খবর ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম, বিভ্রান্তি, অসঙ্গতি সহ বিস্তারিত তুলে ধরাই তাদের কাজ, এখন সে পেশার নাম ভাঙ্গিয়েই চলছে ভয়ংকর ফাঁকিবাজী, চাঁদাবাজি, জোর-জুলুমের হাজারো কারবার। কারা অপকর্মটি করছেন? অনেকেরই তা জানা আছে। সাংবাদিক না হয়েও সাংবাদিকতার বেশভূষা তাদের মূল পুঁজি। খ্যাত-অখ্যাত একাধিক গণমাধ্যমের ৪/৫টি আইডি কার্ড বুকে পিঠে ঝুলিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় সর্বত্র। যারা পেশাদার সাংবাদিক তাদের কারো না কারো সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে সাইনবোর্ড হিসেবেও ব্যবহার করেন তারা। অনেকে সাংবাদিক না হয়েও যানবাহনে প্রেস স্টিকার ব্যবহার করছেন।
বিভিন্ন আবাসিক হোটেল থেকে শুরু করে দেহ ব্যবসার ফ্ল্যাট, ফুটপাত, তেল চোর। ফলের ও মাছের আড়ৎ, পলিথিন থেকে জুস ফ্যাক্টরী সর্বত্রই চাঁদাবাজি করছে সাংবাদিক নামধারী এই চক্র। সম্ভব হলে সাংবাদিকদের কোনো সংগঠনে নিজের নামটা লিখিয়ে নেয়, তা না হলে নিজেরাই ‘সাংবাদিক’ ‘রিপোর্টার’ ‘প্রেসক্লাব’ শব্দ যোগ করে ভূইফোঁড় কোনো সংগঠন খুলে বসে। প্রয়োজনে টাকা-পয়সা খরচ করে রেজিস্ট্রেশনও করিয়ে নেয়। পেশাজীবী সংগঠন গড়তে, বৈধতা পেতে যেহেতু আলাদা কোনো নিয়ম কানুনের দরকার পড়ে না; সেই সুযোগে কাওরানবাজারের আলু পটলের ব্যবসায়ি, মুগদা-মান্ডার বংশানুক্রমের জেলেও এক মুহূর্তেই সাংবাদিক ফাউন্ডেশন নামক সংগঠনের রেজিষ্ট্রেশন পেয়ে যাচ্ছেন। তখন তাদের বুলি থাকে অন্যরকম-“আমি সাংবাদিক কি না সেটা আপনার জানার দরকার নাই, আমি সাংবাদিকদের প্রেসিডেন্ট। আমি সাংবাদিক বানাই, আমার স্বাক্ষরে আইডি কার্ড দেয়া হয়।
সুতরাং আমার পরিচয় আলাদাভাবে দেয়ার কি দরকার আছে? ভূয়াদের এতোসব সাংগঠনিক প্রক্রিয়া ও কথিত ক্লাব-ইউনিটির দাপ্তরিক প্রতারণার দখলে নানাভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মানুষজন। প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে মহান সাংবাদিকতার পবিত্র পেশাটিও। ট্রাক ড্র্ইাভার, সিকিউরিটি গার্ড, ব্যবসায়ী, এমএলএম কর্মকর্তা, কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টেটিভ, নরসুন্দর, দারোয়ান, পান বিক্রেতা, মফস্বলের মুদি দোকানদার কিংবা হোটেল বয় রয়েছে এসব ভুয়া সাংবাদিকদের তালিকায়। এরা অনেকে আবার সম্পাদক ও প্রকাশক। কারন ১২০০ টাকায় পোর্টাল খোলা যায়। তারা বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন পোর্টাল ও পত্রিকার জাল পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় করে। এতে বিপাকে পড়ছেন পেশাদার সাংবাদিকরা। কি গ্রাম , কি শহর সবখানেই এদের দৌরাত্ম্য। দেশের ৬৮ জেলাতেই এদের বিচরন। পুলিশের উদ্বর্তন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভুয়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান নেয়া হবে সারাদেশেই।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ভুয়া সাংবাদিকদের পুলিশ মাঝে মধ্যেই গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে টেলিভিশন চ্যানেল এবং পত্রিকার জাল পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়। তারা মফস্বলে থেকেও ষ্টাফ রিপোর্টার,বার্তা সম্পাদক কিংবা কেন্দ্রীয় নেতা। সাংবাদিক সেজে গোটা উপজেলা দাপিয়ে বেড়ানো চক্রের মধ্যে এক সময়ের অনেক সন্ত্রাসী,দলীয় কর্মী কিংবা নেতা,হোটেল বয়,মুদি দোকানদার কিংবা এনজিও ও ইনসিওরেন্স কর্মীও রয়েছেন। তারা বড় সাংবাদিক। তাদের সাথে কথা বলাই যেন দায়! তাদের দাপটে তটস্থ ঘোর পল্লীর আমজনতা থেকে শুরু করে শহুরে সভ্যতার আধুনিক মানুষেরাও। ওরা মাঝে মাঝে খোদ প্রফেশনাল সাংবাদিকদেরও ঘোল খাইয়ে ছাড়ে। নিজেদের ব্যবসা কিংবা বানিজ্যকে হালাল করতে কিংবা মিডিয়ার হাত থেকে বাঁচতে তারা নিজেরাই খুলে বসেছে পত্রিকা, চ্যানেল কিংবা সাংবাদিক সংগঠন। তারা রিপোর্টার হতে নারাজ। কোন রকমে টাকার বিনিময়ে কার্ড সংগ্রহ করে কয়েকদিন সাংবাদিক থাকার পর তাদের মনে হয় আমার কি টাকা কম আছে? খুলে বসে পোর্টাল।
সাজে সম্পাদক। এরপর নিজেরাই শুরু করে চাঁদাবাজি। সম্প্রতি খোদ রাজধানীতেই ভুয়া সাংবাদিকের ছড়াছড়ি যেন বেড়েই চলেছে। মোটরসাইকেলে কিংবা গাড়িতে প্রেস লিখে রাখলে ট্রাফিক ধরবেনা এমন তথ্যের উপর ভিত্তি করে কার্ড কেনার হিড়িক পড়ে গেছে যেন রাজধানীতে। আর গাড়িতে প্রেস লিখে চলছে চাঁদাবাজি। তারা বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন পোর্টাল ও পত্রিকার জাল পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় করে। এতে বিপাকে পড়ছেন পেশাদার সাংবাদিকরা। এরা এমনভাবে টেলিভিশন চ্যানেলের স্টিকার ক্যামেরায় লাগিয়ে নেয় এটা কি টেলিভিশন চ্যানেলের তা বোঝা খুবই মুশকিল। ফেসবুক কিংবা শত শত ইউটিউব চ্যানেলের স্বঘোষিত সাংবাদিক এরা। এইসব ভুয়া সাংবাদিকদের ঠাটবাট এমন যে তাদের সাধারণ মানুষ সহজে ধরতে পারেন না। এমনকি পেশাদার সাংবাদিকরাও তাদের দেখে মাঝেমধ্যে বিভ্রান্ত হন। তারা অনেকেই দামি গাড়িতে চলা-ফেরা করে। আর ক্যামেরায় জাল স্টিকার লাগিয়ে মানুষকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায় করে। পেশাদার সাংবাদিকরা মনে করেন, ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়ন থাকলে এটি সম্ভব ছিল না।
রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণমাধ্যমের কর্মী পরিচয় দিয়ে ভয়াবহ প্রতারণা চলছে। তারা পত্রিকায় খবর ছাপানোর ভয় দেখিয়ে মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা-পয়সা। অনেকে থানায় দালাল হিসেবে আসামিদের ছাড়িয়ে নিতে মধ্যস্থতা করে থাকে। এসকল ভূয়া সাংবাদিকদের আখড়া এখন যাত্রাবাড়ী, মিরপুর ও উত্তরা এবং গাজীপুর সহ সারাদেশে ছড়িয়ে আছে। আরো অভিযোগ রয়েছে যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা এলাকায় কতিপয় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণকারী, পুলিশের র্সোস নিজেদের সংবাদিক পরিচয় দিয়ে অপর্কম করে বেড়াচ্ছে আর এদের সহায়তা করে থাকে কতিপয় অসৎ পুলিশ সদস্য। আর এতে করে পেশাদার সাংবাদিকরা বেকায়দায় পরছে আর পুলিশ সদস্যরা হারাচ্ছে তাদের বাহিনীর সম্মান।
এছাড়া এরা গলায় সাংবাদিক পরিচয়পত্র আর গাড়িতে প্রেস লেখা স্টিকার লাগিয়ে মাদক পাচার এমনকি রাজনৈতিক সহিংসতার সময় ককটেল ও বোমাও বহন করছে। সাংবাদিক পরিচয়ধারী এসব প্রতারক চক্র শুধু নামসর্বস্ব পত্রিকার আইডি কার্ড বহনই নয়, বিভিন্ন ঘটনাস্থলে গিয়ে তারা মূল ধারার বড় পত্রিকার সাংবাদিকও পরিচয় দেয়। তাছাড়া ভূইফোঁড় পত্রিকা অফিসগুলো সাংবাদিক পরিচয়পত্রও বিক্রি করে থাকে। এসব পরিচয়পত্র পকেটে রেখে বিভিন্ন প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইলের সামনে সাংবাদিকদ বা প্রেস লেখা স্টিকার লাগিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় সারাদেশে। এদের কাজ হলো নতুন উদ্দ্যেক্তাদের হেনস্থা করা। ফ্যাক্টরী কিংবা যে কোন ব্যবসা প্রতিষ্টান কিংবা সমাজের নীরিহ ব্যক্তিরা এদের টার্গেট। ২০ থেকে ৫০ টাকার চাদাবাজী করা আর রাত হলে থানার গেইট বিভিন্ন মামলার তদবির করে যা কামানো যায়।
বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী ও টঙ্গী থানার সামনে গেলে দেখা যায় শত শত নামধারী সাংবাদিক দিনের বেলায় সোর্স আর রাতের বেলা সাংবাদিক। অভিযোগ রয়েছে এদের কারনে পুলিশ সদস্যরাও কাজ কর্ম করতে নানান সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী ও গাজীপুরে এসব ভুয়া সাংবাদিকদের ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা গেছে। কথিত সাংবাদিক পরিচয় দেয়া এসব ব্যক্তির হাতে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তারা শুধু নামসর্বস্ব পত্রিকা বা অনলাইনের আইডি কার্ড বহনই করেন না বরং মূল ধারার জাতীয় দৈনিক কিংবা টেলিভিশনের সাংবাদিক পরিচয় দিয়েও মানুষকে জিম্মি করছেন। বেশ কিছু ভুয়া ও অখ্যাত পত্রিকা এবং অনলাইনের সাংবাদিক পরিচয়ে অনেকে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।ভূয়া সাংবাদিকদের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে খোদ পুলিশেরও অনেকটা ভুমিকা রয়েছে।
কারণ, পুলিশের সঙ্গেই ওইসব ভূয়া ও নামধারী সাংবাদিকদের বেশি সখ্যতা। এরা প্রায়ই থানার ভিতরে দারোগাদের সাথে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডাবাজিতে মত্ত থাকে। ‘দালাল’ হিসেবে ঘুষ বাণিজ্যে সরাসরি সহায়তা করে, পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবেও তারা বিশ্বস্থ! কারন অনেক পুলিশ সদস্য না চিনেই তাদের সুযোগ দিচ্ছেন। সারা দেশে ‘ভুয়া মানবাধিকার কর্মি আর ভূয়া সাংবাদিক’দের দৌরাত্ম্য অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে চরমে পৌঁছেছে। ভুয়া সাংবাদিকেরা বিভিন্ন প্রতারণার ফাঁদ পেতে এবং তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠনের সদস্য-সমর্থকরা নিজেদেরকে ‘মানবাধিকার সাংবাদিক’ পরিচয় দিয়ে নিরীহ লোকজনকে নানাভাবে হয়রানি করছে বলেও বিস্তার অভিযোগ উঠেছে।
সাংবাদিক পরিচয়ে এরা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখল, দোকানপাট দখল, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে জড়িত হয়ে পড়ছে। এই চক্রে বিতর্কিত নারী সদস্যও থাকেন। এরা মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসে ‘প্রেস’ কিংবা ‘সংবাদপত্র’ লিখে পুলিশের সামনে দিয়েই দাঁবড়ে বেড়ায়। এদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও বিভিন্ন যানবাহনও থাকে চোরাই এবং সম্পূর্ণ কাগজপত্রবিহীন। ভূয়া সাংবাদিক আর কথিত মানবাধিকার কর্মিদের নানা অপকর্মের কারণে প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিকদের ভাবমূর্তি এখন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এসব ফেসবুক সাংবাদিক আর মানবাধিকার নেতার জয়জয়কার চারিদিকে। এরাই এখন স্বঘোষিত সাংবাদিক নেতা। এতে করে পেশাদার সাংবাদিকরা আজ নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন। কবি তার ভাষায় টিটকারী করে লিখেছেন ছড়া হঠাৎ করে এই শহরে এলো যে এক সাংবাদিক, কথায় কথায় তোলে ছবি ভাবখানা তার সাংঘাতিক।
তিলকে সে বানায় তাল-তালকে আবার তিল, চড়ুইকে সে পেঁচা বানায় কাককে বানায় চিল। পুলিশ দেখে মুখ লুকিয়ে পালায় দিকবিদিক, সবাই বলে লোকটা নাকি ভূয়া সাংবাদিক। পেশাদার সম্মানিত সাংবাদিকদের জন্য বিষয়টি লজ্জাকর হলেও ছড়ার ছন্দের মতই ভূয়া সাংবাদিকরা দেশ জুড়ে বেহাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে ফেলেছে। সাংবাদিকদের মতো বেশভূষায় সেজেগুজে একশ্রেণীর প্রতারক অলিগলি, হাট-বাজার চষে বেড়াচ্ছেন। পান থেকে চুন খসলেই রীতিমত বাহিনী নিয়ে হামলে পড়ছেন সেখানে। প্রকৃত ঘটনা কি-সে ঘটনার আদৌ কোনো নিউজ ভ্যাল্যু আছে কি না, সেসব ভেবে দেখার ফুসরৎ তাদের নেই।
তাদের দরকার নিজেদের প্রতাপ দেখিয়ে, আতংক ছড়িয়ে টুপাইস কামিয়ে নেয়া। টাকা পকেটে না আসা পর্যন্ত চিল্লাপাল্লা, হুমকি, ভীতি প্রদর্শনের সব কান্ডই ঘটিয়ে থাকেন তারা। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত পল্লীর সাধারণ বাসিন্দারা পর্যন্ত কথিত সাংবাদিক কার্ডধারী ভূয়াদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন, তটস্থ থাকছেন। পেটে বোমা ফাটালেও দু’ লাইন লেখার যোগ্যতাহীন টাউট বাটপারের দল চাঁদাবাজিতে সিদ্ধহস্ত।
এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়
Leave a Reply