(ঈদ বা খুশির ধারণা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, প্রিয়জনদের দূরে রেখে ঈদ করার কষ্ট, চিরায়ত সাংস্কৃতিক অভ্যাস ও মূল্যবোধ, মৃত্যুভয়কেও তোয়াক্কা করে না। প্রচন্ড গমের মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পণ্যবাহী পিকআপভ্যানে, ট্রাকের ভেতর তেরপলের তলে আলু, চালের বস্তার মতো গাদাগাদি করে মানুষ শহর থেকে গ্রামমুখী হয়েছে প্রিয়জনদের সাথে ঈদ করতে।)
শের ই গুল :
প্রচন্ড গরম এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির মধ্যে দরজায় কড়া নাড়ছে বছরের অন্যতম প্রতীক্ষিত উৎসব ইদুল ফিতর। দেখতে দেখতে প্রায় পেরিয়ে গেল পবিত্র রমজান মাস। এবারও রমজানের রোজার শেষে ঈদ আসছে, তবে খুশির ডালা সাজিয়ে নয়, আসছে আনন্দ-আশঙ্কা-অনিশ্চয়তার অবিমিশ্রিত বার্তা নিয়ে।
আনন্দের সবচেয়ে বড় উপলক্ষ ঈদ, কিন্তু দৃশ্যমান কোন প্রস্তুতি নেই, নাম মাত্র কেনাকাটা, নতুন জামা কাপড় পড়ে আত্মীয় স্বজনের বাসায় বেড়ানো, নেমন্তন্ন খাওয়া, প্রিয়জনকে জড়িয়ে ধরা, কোলাকুলি, ঘনিষ্ঠ হয়ে সেল্ফি তোলা, প্রচন্ড গরমে এবং দ্রব্যমল্যের উর্ধ্বগতিতে আবার তার সাথে যোগ হয়েছে ক্ষনে ক্ষনে বিভিন্ন স্থানে লাগা আগুন। তবুও সবকিছু মিলিয়ে এর নাম ঈদ।
আবার কেউ অধিক অর্থ ব্যয় করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে ইজিবাইক, ইঞ্জিন রিক্সা, প্যাডেল রিক্সা, ভটভটি, ভাড়ায় মোটরসাইকেল, নসিমন, করিমন, পায়ে হেঁটে ফিরেছে গ্রামে প্রিয়জনদের সাথে ঈদ করতে। একদল মানুষ নিজেদের মোটরসাইকেল করে ফিরেছে, কেউ ভাড়ায় চালিত ব্যক্তিগত গাড়িতে করে ফিরেছে। কেউ হয়তো ব্যক্তিগত গাড়ি করে গ্রামমুখী হয়েছে; আর যারা ভি আই পি, তারা হয়তো যথাযথ প্রটোকল নিয়েই নিজ এলাকায় আনন্দ ভাগাভাগি কাম রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়েছেন। নাগরিক মানুষের গ্রামে যাওয়ার সময় ব্যবহৃত যানবাহন ও তাদের “ঈদ যাত্রায় ব্যক্তি আচরণকে” (ইবযধারড়ৎধষ ধংঢ়বপঃ) বিবেচনা করলে একটা সামাজিক স্তরায়ন খুব সহজেই দেখতে পাওয়া যায়। সে বিষয়ে আলোচনা করলে “চাকরি থাকবে না”। তাই প্রসঙ্গ না বাড়িয়ে শুধু একটা কথা বলি, ঈদে বাড়ি ফেরাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নে যে দ্বিধা ও দ্বৈততা তা খুবই নগ্ন হয়ে সামনে এসেছে। প্রচন্ড গরমের এই আকালের দিনে ঈদ সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দেশে নতুন করে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ। পুরোনো দরিদ্র মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। নতুন দরিদ্রদের মধ্যে শহুরে লোকজন অনেক। এতে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত যোগ হচ্ছে। বহু লোক শহর ছাড়ছে। বহু লোকের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ। খরচ কমাতে কমাতে তারা দারিদ্র্যের দ্বারপ্রান্তে। মধ্যবিত্ত হয়েছে নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত হয়েছে নিম্নবিত্ত, নিম্নবিত্ত হয়েছে দরিদ্র। নতুন ও পুরোনো মিলে এখন দরিদ্র জনসংখ্যার আকার হবে বিশাল।
সরকার বলছে, ‘জীবন ও জীবিকার’ বাজেটের কথা। কিন্তু জীবিকা তো দুই ধরনের। ধনীদের জীবিকা, গরিবের জীবিকা। গরিবের জীবিকা, ঈদ, দৈনন্দিন খরচের দায়িত্ব কে নেবে? প্রচন্ড গরম এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে এমনিতেই কাজ না থাকায় কোন না কোন ভাবে সকলের আয়ের ওপর বড় একটা চাপ পরেছে। ঈদের আগের রাতে বসে একটা বিষয় অনুধাবন করেছি যে, বাঙালী মুসলমান সমাজে ঈদ পালন কেবলমাত্র ধর্মীয় আচার পালন নয়। এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য (গুরুত্ব) রয়েছে।
সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে পরিবার, জ্ঞাতি, সমাজ, স্থানিকতা, পূর্বপুরুষের ভিটা, মানুষের সামাজিক শেকড়ের টান এখনো বাংলাদেশী সমাজে শক্তিশালী। ঈদের দিন সকালে মৃত আত্নীয়স্বজনের কবর জিয়ারত করার সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অর্থনীতির যৌক্তিকতা দিয়ে বোঝা যায় না। এখানেই মানুষের মনোসামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট প্রাসঙ্গিকতা পায়। মানুষ নাগরিক জীবনের মাঝে প্রবেশ করলেও পুরোপুরি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে নি। নগরের সিংহভাগ মানুষ গ্রাম থেকে অভিবাসিত, অভিবাসনে পুশ-পুল যে অনুসঙ্গই কাজ করুক না কেন, ব্যক্তি জীবনে সামাজিক শেকড়ে যুক্ত থাকাটা সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ।
ঈদে গ্রামে যাওয়া আসলে কী অর্থ বহন করে, গ্রাম থেকে জীবিকার খোঁজে নগরে আসা ব্যক্তি মানুষের কাছে? এই প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর নাই, একেক ব্যক্তির ব্যক্তিক আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট একেক রকম, একেক জনের বাস্তবতার নিরিখে একেকটি বিষয় প্রকটতর হয়। তবুও সাধারণীকরণ করার প্রবৃত্তি থেকে বুঝতে চাইলে, সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্ববোধ (এর মাঝেই অর্থনৈতিক ব্যাপার নিহিত), সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং আবেগ, ধর্মীয় আচার প্রতিপালনকে ঘিরে ধর্মীয় মূল্যবোধ ইত্যাদি বিবিধ বিষয় আমলে নেয়া যায়। ঈদ উদযাপনের জন্য গাইডলাইন- পরিস্থিতির গুরুতরতার কথা মাথায় রেখে অনেক ধর্মীয় সংস্থা এবং সম্প্রদায়ের নেতারা জনসমাগম এড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
নানারকম সুস্বাদু খাবার ঈদ উদযাপনের একটি বড় অংশ। ভোজের জন্য প্রস্তুতি প্রায় একদিন আগে থেকেই শুরু হয় এবং পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুবান্ধবদের জন্য বিভিন্ন ধরণের খাবার থেকে রান্না করা হয়। ঈদের সন্ধ্যায় একে অপরের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া এবং পার্টির আয়োজন করে। কিন্তু কোনো উৎসবই সুন্দর পোশাক ও সাজসজ্জা ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। নতুন পোশাক নেই তো কী হয়েছে, আগের বছরের পোশাক থেকেই একটি সুন্দর পোশাক বাছাই করুন। কাপড়ে সুগন্ধি আতর ছড়িয়ে দিন। এটি উৎসবের আমেজ বাড়িয়ে তুলবে। যত কিছুই হোক, সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ করুন নিজেকে অন্যদের থেকে দূরে রাখার সর্বোত্তম চেষ্টার পরেও যদি কেউ বেড়াতে চলে আসে তবে অতিথিকে স্বাগত জানাতে গিয়ে কমপক্ষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করা উচিত।
বাংলা বৈশাখ মাসের শুরু, সেই সঙ্গে পবিত্র রমজান মাসেরও শেষের দিকে। আমরা পেছনে ফেলে এসেছি বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ, এরও আগে চৈত্রসংক্রান্তি এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত নানা উৎসব-মেলা। এখন সারা দেশে কৃষক ভাইয়েরা আমাদের প্রধান ধানী ফসল ‘বোরো’ তুলতে ব্যস্ত। বলা হচ্ছে, বাম্পার ফলন হয়েছে এবার। সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে ১০-১৫ লাখ টন খাদ্য সংগ্রহের জন্য।
আবার পবিত্র ঈদ, দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব সামনে। ঘটনাক্রমে সরকারের রাজস্ব বছর শুরু হতে দেরি নেই। মাস দেড়েক বাদেই সরকার নতুন অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেট সংসদে পেশ করবে। এবার হবে ‘গরিবের বাজেট, জীবন-জীবিকার বাজেট’- তা-ই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এতসব উল্লেখযোগ্য দিবস, উৎসব, মেলা, নতুন ধান ওঠার মধ্যে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড থাকার কথা ছিল তুঙ্গে। ‘ক্যাশ’ বা ‘নগদের’ ছড়াছড়ি থাকার কথা ছিল অর্থনীতিতে।
সারা দেশের ছোট, মাঝারি শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানদার, দোকান কর্মচারী, হাজার ধরনের পেশাজীবীর জীবন থাকার কথা ছিল কর্মচঞ্চল। সেই সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের জীবনেও থাকার কথা ছিল আনন্দ। অর্থনীতির অবস্থা থাকার কথা রমরমা। প্রশ্ন, তা কি আছে? এক কথায় এর উত্তর দেওয়া যায়। বছর কয়েক হলো বিশাল এক করোনা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়ে গেছে। এখন প্রচন্ড গরম।
দ্রব্যমূল্যের দামের উর্ধ্বগতি চারদিকে অভাব-অনটন, উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা। যখন লিখছি, তখন চলছে কড়া ‘বাহিরে মাটি ফাটা রোদ’। পূর্বের করোনার কথা ভেবে আলিঙ্গন বা হ্যান্ডশেক এড়িয়ে চলুন, একটি মাস্ক পরুন এবং আলাপচারিতার সময় কমপক্ষে এক মিটার দূরত্বে থাকুন। ঘন ঘন সাবান-পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার রাখতে ভুলবেন না। ঈদ হোক নিরাপদ।
এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়
Leave a Reply