আওরঙ্গজেব কামাল :
ফিটনেসবিহীন বাসের দুর্ঘটনার দায়ভার কার। মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। কিন্তু দুর্ঘটনা কমছে না। থামছে না সড়ক-মহাসড়কে বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর জন্য লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক ও মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন যেমন দায়ী, তেমনই বেপরোয়া ও অসচেতন পথচারীদের দায়ও কম নহে।
চালকদের মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো তার অন্যতম কারন বলে মনে করেছেন অনেকে। মাদারীপুরের শিবচরে এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে এব ৩০ জন আহত হয়েছে। মোট ৪৩ জন যাত্রী নিয়ে খুলনা থেকে ছেড়ে যায় বাসটি। অথচ ইমাদ পরিবহণের বাসটিতে কোনো ফিটনেস ছিল না। খুলনা ও ঢাকার মধ্যে চলাচলকারী বাসটি কীভাবে বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশের নজরদারি এড়াল তা নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয় নিয়ে ট্রাফিক বিভাগের গাফিলাতি বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। এই বাসটি গত বছরও বাসটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল। এ কারণে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ বাসটির রেজিস্ট্রেশন প্রাথমিকভাবে স্থগিত করেছিল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্ঘটনাকবলিত ইমাদ পরিবহণের গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৩৩৪৮। ভারতের অশোক লে ল্যান্ড কোম্পানির গাড়িটি ২০১৭ সালে তৈরি। ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি এটি রেজিস্ট্রেশন করা। এর মালিকানায় রয়েছে-সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (পান্থপথ শাখা) এবং ইমাদ পরিবহণ প্রাইভেট লিমিটেড। ঠিকানা দেওয়া হয়েছে ইফাদ অটোস লিমিটেড, ২১ রাজউক এভিনিউ এবং আরেকটি ঠিকানা গোপালগঞ্জের আলিয়া মাদ্রাসা রোড।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, বাসটির ফিটনেস ছিল না। ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি বাসটির ফিটনেসের জন্য আবেদন করা হয় এবং এ বছরের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত মেয়াদ ছিল। গত বছরের নভেম্বরে বাসটি গোপালগঞ্জে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
এ কারণে বিআরটিএ’র ওয়েবসাইটে বাসটির রেজিস্ট্রেশন স্থগিত করে রেখেছিল। রোববার দুর্ঘটনাকবলিত বাসটির বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের অভিযোগ, বাসটি প্রথম থেকে বেপরোয়া গতিতে চলছিল। এজন্য বাসের চালককে কয়েকবার সতর্কও করা হয়েছিল। কিন্ত তাকে কোন লাভ হয়নি।
এ ঘটনার বিচারের দাবী জানিয়েছেন, বাস দুর্ঘটনায় নিহত খুলনার সোনাডাঙ্গা এলাকার আব্দুল্লাহ আল মামুনের মা নুরনাহার বেগম। নিহত এলাকার আব্দুল্লাহ আল মামুন পূবালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে ঢাকার মুগলটুলী শাখায় কর্মরত ছিলেন।
শিবচর হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু নাঈম মো. মোফাজ্জেল হক বলেন, অতিরিক্ত গতির কারণে বাসটির চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে সেটি খাদে পড়ে এই দূর্ঘটনা ঘটে। একাধিক সূত্র জানায়, খুলনা সার্কেলে প্রায় ১৭ হাজার যানবাহনের মধ্যে ৩ হাজার ৩০০টির ফিটনেস নেই। এ তথ্য ফেব্রুয়ারি মাসের।
এ ছাড়া ১৮৫টি অ্যাম্বুলেন্সেরও ফিটনেস নেই। শিবচরে দুর্ঘটনাকবলিত ইমাদ পরিবহণের বাসটি দুই মাস আগে ফিটনেসের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। অথচ যানবাহনটি প্রতিদিন খুলনা মহানগরী ও জেলায় চলাচল করত। অথচ নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও বিষয়টি তাদের নজরদারিতে আসেনি।
বিআরটিএ’র খুলনার সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) প্রকৌশলী তানভীর আহমেদ জানান, জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ ও বিআরটিএ সমন্বয়ে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। ফিটনেসবিহীন যানের ফিটনেস নবায়ন করার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, মাইকিং ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়। এমনকি ফিটনেস খেলাপি যানের মালিকদের কাছে তাদের যানবাহন নবায়ন করার জন্য
রেজিস্ট্রিযোগে চিঠি পাঠানো হয়।
এ ছাড়া জেলা প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ফিটনেস খেলাপিদের তালিকা পাঠানো হয়। খুলনা ট্রাফিক পুলিশের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) তাজুল ইসলাম বলেন, কেএমপি কমিশনারের নির্দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিষয়ে আমাদের বিশেষ অভিযান অব্যাহত আছে। নগরী ও হাইওয়েতে কোনোভাবেই যেন ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল না করে সেজন্য আমরা সক্রিয় আছি। জানা গেছে, আইন অনুযায়ী ফিটনেসবিহীন বা মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচলে অনধিক ৬ মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান থাকলেও তা তেমন কার্যকর করা হয় না। এখন জনসাধারনের
প্রশ্ন কি ভাবে এই ফিটনেসবিহীন বাস যাত্রী নিয়ে রওনা হলো। তাহলে কি রাস্তায় কোন ট্রাফিক ছিলোনা ,আর যদি থাকে তাহলে তারা কেন এই ফিটনেসবিহীন বাসটি যেতে দিলো। এ দুর্ঘটনার দায়ভার কে বহন করবে ?
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার এবং আহত হয়েছে প্রায় ৬২ হাজার মানুষ। এসব সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩% ঘটে গাড়ির অতিরিক্ত গতির কারণে, ৩৭% চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে এবং আর ১০% গাড়ির ত্রুটি ও পরিবেশের কারণে। অন্যদিকে পথচারীরা যদি রাস্তার এক পাশ থেকে অন্যপাশে যাওয়ার সময় যদি রাস্তা ব্যবহার না করে ওভারব্রিজ ব্যবহার করে, রাস্তা যদি সতর্কতার সঙ্গে অতিক্রম করে তাহলে এই সব সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে এড়ানো সম্ভাব।
এ বিষয়ে জনসাধারন বলছেন, ড্রাইভার ও হেলপাররা আগের মতোই বেপরোয়া আচরণ করছে। সব মিলিয়ে এখন সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে সড়ক পরিবহনে সুনির্দিষ্ট কিছু আচরণবিধি বাধ্যতামূলকভাবে মানার বিষয়ে কঠোর হতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এখন যেন কোনো খবরই নয়! অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব দুর্ঘটনার ব্যাপারে আইনগত কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। সড়ক দুর্ঘটনায় কুকুর-শিয়ালের মৃত্যু হলে যতটা শোরগোল হয়, তার ছিটেফোঁটাও হয় না মানুষের মৃত্যুতে। পরিস্থিতি দেখে মনে
হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হবে—এটাই তো স্বাভাবিক। কাজেই এ নিয়ে কথা বলার তো কিছুই দেখি না। প্রতিটি মৃত্যুর দায়ভার সরকার কিংবা গণপরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলে এমনিতেই কমে যাবে দুর্ঘটনার পরিমাণ। চালক ও শ্রমিকরা বলছেন, মহাসড়কে স্বল্প গতির অবৈধ
যানবাহন ও অপরিপক্ক চালকের কারণে দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তবে বিআরটিএ সূত্র বলছে, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে মহাসড়কে। আর পুলিশ বলছে, অধিক গতি ও বেপরোয়া চালনাই সড়কে দুর্ঘটনার কারণ। সব মিলিয়ে সড়ক প্রশস্তকরণসহ কিছু উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন যানবাহন সংশ্লিষ্টরা।
লেখক ও গবেষক- আওরঙ্গজেব কামাল, সভাপতি, ঢাকা প্রেস ক্লাব।
এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়
Leave a Reply