(খাদ্য ও ঔষধে ভেজাল, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে দূর্নীতি, বিয়ের নামে প্রতারণা, বিদেশ পাঠানো, জ্বীনের বাদশা ও পিলার এবং ভূমিদস্যু-জমি জালিয়াতী, ফ্ল্যাট, নিয়োগ বাণিজ্য, বিকাশ, ফেসবুক, ভন্ডপীর, ছদ্মবেশী প্রতারণা, ভোটার আইডি কার্ড জালিয়াতি, এমএলএম ও অনলাইনে ব্যবসা, ছবি বাণিজ্য, সেল্ফি সহ সব ক্ষেত্রে প্রতারণা চলছে। প্রশাসন বলছে, মূলত লোভের ফাঁদে পড়েই মানুষ বেশি প্রতারিত হচ্ছেন। তবে অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রতারণার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসৎ কর্মকর্তাদের আতাত ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা প্রতারকদের প্রতারণা করতে উৎসাহ বাড়াচ্ছে।)
শের ই গুল :
দেশে চলছে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে প্রতারণা, বিগত অনেক বছর ধরে আলোচনায় চলে আসছে নানা প্রতারণাকাণ্ডের গল্প। প্রতিবছর বিগত বছরের চেয়ে দেশে প্রতারণার বিষয়টি আপডেট হচ্ছে নিত্য নতুন ভাবে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় কিছু অসাধু প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আতাতে দেশের সর্বত্র বসেছে প্রতারণার মেলা। পুলিশ বলছে, মূলত লোভের ফাঁদে পড়েই মানুষ বেশি প্রতারিত হচ্ছেন।
এছাড়া অজ্ঞতাও একটি কারণ। তবে প্রতারণা থেকে বাঁচতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। তবে অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রতারণার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঢিলেমি অসৎ কর্মকর্তাদের আতাত ও রাজনৈতিক মদদ একটি বিষয়। আরেকটি বিষয়ও রয়েছে কম সময়ে বেশি লাভবান হওয়ার আশা। প্রতারকরা এমন লোভ দেখিয়ে শিক্ষিত মানুষদেরও বোকা বানাচ্ছে। এমএলএম ব্যবসা থেকে শুরু করে নানা রকম জালিয়াতি-প্রতারণার ডজন-ডজন মামলার খবর এখন নতুন কিছু নয়। সুকৌশলে প্রতারকরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভিভিআইপিদের অতিথি করে তাদের সাথে মঞ্চে বসে ছবি তুলে করছে প্রতারণা।
এদের মধ্যে কোন কোন প্রতারক আইনের আওতায় আসলেও জেলখানায় নাকি বহল তবিয়তে থাকে, বলা যায় সেখানেও চলছে প্রতারণা। সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও সরকারি আমলাসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা অসংখ্য সেলফি প্রতারকদের ফেসবুক পেইজের শোভা বাড়িয়ে থাকে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও দেশের চলমান সকল আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রতারক কু-চক্রী গোষ্ঠী প্রতারণার জাল ছড়িয়ে মানুষ ঠকিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ ও সম্পদ। খাদ্য ও ঔষধ ভেজালে প্রতারণা, রাজনীতির নামে প্রতারণা, করোনা পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণা, বিয়ে করে প্রতারণা, বিদেশ পাঠানোর নামে প্রতারণা, জ¦ীনের বাদশার প্রতারণা, পিলার প্রতারণা, ভূমিদস্যু-জমি জালিয়াতী প্রতারণা, ফ্ল্যাট প্রতারণা, নিয়োগ বাণিজ্য প্রতারণা, বিকাশ প্রতারণা, ফেসবুকে বন্ধু সেজে উপহার দেয়ার নামে প্রতারণা, ভন্ডপীরের প্রতারণা, ছদ্মবেশী প্রতারণা, ভোটার আইডি কার্ড জালিয়াতি প্রতারণা, এমএলএম ও অনলাইনে ব্যবসার নামে প্রতারণা।
এমএলএম ব্যবসা খুলে গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ, চাকরির নামে অর্থ নেয়া, ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে কো-অপারেটিভ থেকে অর্থ আত্মসাৎ, ব্ল্যাকমেইলসহ নানা প্রতারণার অভিযোগ দেশব্যাপী ছড়িয়ে আছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় প্রতারকরা দেশে প্রতারণার রাজত্ব কায়েম করেছে। সিআইডির জালে ধরা পড়ে সাদিয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌস (৩৮) নামে এক নারী। কখনো অবিবাহিত যুবক, কখনো বিপত্নীক, কখনো তালাকপ্রাপ্তা, কখনো নামাজি, আবার কখনো বয়স্ক পাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন দিতেন এ নারী। যে পাত্রের জন্য যেমন পাত্রী দরকার তেমন রূপেই নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টা করতেন তিনি। বিশেষ করে ধনাঢ্য পাত্রদের টার্গেট করে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দিয়েই বেশি প্রতারণা করে টাকা নিতেন। এভাবে গত প্রায় ১০ বছর ধরে শতাধিক পাত্রের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি-কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় জান্নাত।
এভাবে প্রতারণা করে ২০ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হন এ নারী। এরকম হাজারও প্রতারণার গল্পে এখন মানুষের মুখে মুখে। বাংলাদেশের মানুষ প্রতি ৫ জনের মধ্যে ৪ জন কোন না কোন ঝগড়া-বিবাদ মামলায় জড়িত আছে। শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে মানুষ বাঁচাতে যে ঔষধ ব্যবহার করা হয় সেখানেও এখন সবচেয়ে বড় ভেজাল কাজ করছে। এগুলো নিয়ে পত্র-পত্রিকায় ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় হচ্ছে হাজারোও সংবাদ। কিন্তু বিবেকবান মানুষের ঈমান, অবৈধ টাকার হাতছানিতে মরিচিকা পড়ে সমাজের আস্থাকুড়ে অবস্থান করছে।
এছাড়া ফেসবুকে বন্ধু বানিয়ে উপহার দেয়ার নামেও প্রতারণায় সক্রিয় আছে নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকা থেকে আসা বিদেশি নাগরিকসহ অনেক প্রতারকরা। দেশীয় কিছু ব্যক্তির সহায়তায় প্রতারণার ফাঁদে ফেলে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। ভোটার আইডি কার্ড জালিয়াতি করেও ঋণ নিয়ে গেল অনেক প্রতারকরা। এ কাণ্ডে নাম আসে জাতীয় নির্বাচন কমিশনে কর্মরত কিছু সদস্যের নামও।
এছাড়া ই-কমার্স ব্যবসার নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে বিভিন্ন মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ইতিমধ্যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। প্রতারণায় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান গুলো ‘পিরামিড’ পদ্ধতিতে লভ্যাংশ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ গ্রাহকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করছে। এদেরকে প্রথমে সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমতি দেওয়া হয়।
নূন্যতম ট্রেড লাইসেন্সটি নিতে প্রতারকদের কোন সমস্যা হয়না। তারপর শুরু করে প্রতারণার বাণিজ্য। একসময় প্রতারণা করতে করতে নিরহ মানুষকে নিঃস্ব করে স্বর্বস্বান্ত করে কেটে পড়লে টনক নড়ে সরকারের। ততক্ষণে শিয়াল মুরগি খেয়ে পালিয়ে গেছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্যানুসন্ধানের পর এসব চক্রের অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হলেও তাদের অনুসারীরা চালায় প্রতারণা চক্র। দেশে ভণ্ড পীর ও তাবিজ মোল্লাদের প্রতারণা চলছে আদিকাল থেকেই। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত অনেকেই তাদের প্রতারণার শিকার।
সব সমস্যার ভোগান্তির সমাধান রয়েছে তাদের কাছে। চিকিৎসকেরা যে সব কঠিন মারাত্মক রোগের চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন, যেসব রোগীর রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসক জানিয়ে দেন, এ রোগীর চিকিৎসা নেই বা বাঁচার দিন ফুরিয়ে আসছে। রোগীর পরিবার পরিজন কিন্তু হাল ছাড়েন না। সে সময় তারা শরণাপন্ন হন ভণ্ড পীর কিংবা তাবিজ মোল্লাদের দুয়ারে, আকুতি জানান স্বজনকে বাঁচানোর। ভণ্ডদের কাছে কোনো ব্যাপারই না, সব রোগের চিকিৎসা রয়েছে। গ্যারান্টি সহকারে চিকিৎসা করা হয়। মাঠপর্যায়ে রয়েছে তাদের গুণকীর্তন করার দল। তাদের আস্তানায় যাওয়ার আগে মিলবে তাদের অনেক তথ্য, মিলবে বেশ প্রমাণ যারা তাদের মাধ্যমে ফিরে পেয়েছে নতুন জীবন, মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে শুনাবে তার মিথ্যা কাল্পনিক বানোয়াট কাহিনি।
সবই পাতানো, ওরা ভণ্ড পীর ও তাবিজ মোল্লাদের নিয়োগ করা, এদের কাউকে বেতন অথবা কাউকে কমিশন দেওয়া হয়। এভাবেই প্রতারক ভণ্ডরা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের তাণ্ডব। তাদের কাল্পনিক মিথ্যা কাহিনির গল্প এক জেলা হতে অন্য জেলা কিংবা বিভাগে ছড়িয়ে পড়ে, রয়েছে তাদের এজেন্ট, দেশের ধনী অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করা হয় তাদের কাহিনি। এমনকি পারিবারিক কলহ বা সমস্যা বিভেদ ঝগড়া এগুলোর সমাধানের নিমিত্তে একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান তারা। স্বামী স্ত্রীর দ্বন্দ্ব, অমিল; ভাই ভাইয়ের কিংবা বাবা মায়ের সম্পদ আয়ত্ত করা; কাউকে প্রেম বা বিয়েতে রাজি করানো; সবই শতভাগ গ্যারান্টির মাধ্যমে করা হয়। বিনিময়ে গুনতে হবে হাজার হাজার এমনকি লাখ লাখ টাকা। তবে সাক্ষাৎকালে তারা অথবা এজেন্টদের মাধ্যমে জেনে নেয় মক্কেলের আর্থিক অবস্থা। আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করেই খরচের হিসেবে দেওয়া হয়। যথেষ্ট লেখালেখি হয়েছে, রিপোর্ট, শিরোনাম হয়েছে কিন্তু তেমন কাজ হয়নি। আজও তারা চালিয়ে যাচ্ছে অবলীলায় তাদের ব্যবসা বাণিজ্য।
এ ক্ষেত্রে বিত্তবান কিংবা মধ্যবিত্ত ছাড়াও প্রতারিত হন বহু প্রবাসী। তাদের খুঁটির জোর অনেক। মন্ত্রী, এমপি, পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাদের মুরিদ, শুভানুধ্যায়ী। আমাদের সমাজের অনেকেই এদের বিপক্ষে, তারা এসব কুসংস্কার পছন্দ করেন না। আমার এক খালাতো বোন কনক আমাকে জানায়, আমার মা বাবা আবার বিভিন্ন পীরের ভক্ত, বাবা মায়ের সামনে তাদের সমালোচনা করা যাবে না। মা রেগেমেগে বলতেন মহাপাপ হবে, তওবা করো অন্যথায় বিপদ হবে। জিনপরি এদের খবরাখবর রাখে, যেথায় ওদের বিরুদ্ধে আলোচনা হয় ওরা জিনপরির মাধ্যমে জেনে নেয়। তাই মোটেই বাবাদের সমালোচনা করা যাবে না। সেই আদি যুগের মা আমার, তাই মা যাতে মনে আঘাত না পায়, বলতাম ভুল হয়ে গেছে মা। মা তাদের এতই ভক্ত ছিলেন, প্রতি মাসে নিয়মিত বড় অঙ্কের টাকা আমাদের পরিবার থেকে চলে যেত পীর বাবার পকেটে।
সিংহভাগ টাকাই প্রতারকদের পকেটে যেত। যেকোনোভাবে প্রতারক দলের এজেন্টদের কাছে খবর চলে যেতো শাহজাহান সরকারের স্ত্রী কনকের আম্মা পীর পাগল। রাজধানী সহ দেশের সর্বত্র মোড়ে মোড়ে রয়েছে এসব ভন্ডদের বিজ্ঞাপন। ভণ্ডরা প্রতারণার জাল ছড়িয়ে রেখেছে দেশব্যাপী। জিন-ভুত তলব করে চিকিৎসার সমাধান দিবে। কালো খাসি, লাল গরু, স্বর্ণ, রুপা, এগুলো দিতে হবে। কত টাকা সেটা জিন-ভুত বলে দিচ্ছে। এগুলো দিলেই শারীরিকসহ সব ধরনের ঝামেলা থেকে মুক্তি আসবে, অন্যথায় মহাবিপদের সম্মুখীন হতে হবে। এভাবে বেহিসাব টাকা ভণ্ডরা নিয়ে যায় বিভিন্ন প্রতারণার ছলনায়।
এভাবে ভণ্ডদের পেছনে টাকার অপচয় হচ্ছে। অর্থের অভাবে যারা চিকিৎসা নিতে পারছে না, মেঘ বৃষ্টিতে যাদের ছাউনি নেই, তাদের সাহায্য করলে দুনিয়া আখেরাতে পুরস্কৃত হওয়া যায়। দেশের আইন প্রশাসন এগুলোর প্রতি নজর না দিলে সরল মনের মানুষেরা প্রতারিত হতেই থাকবে। প্রতারণার মামলা নিয়ে কাজ করা ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের সহকারী কমিশনার প্রাণের বাংলাদেশকে বলেন, মূলত লোভের ফাঁদে পড়েই মানুষ বেশি প্রতারিত হচ্ছেন।
এছাড়া অজ্ঞতাও একটি কারণ। অনেকেই প্রতারিত হলেও আইনের সহায়তা নিতে চান না। তবে প্রতারণা থেকে বাঁচতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স (সিপিএস) বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক প্রাণের বাংলাদেশকে বলেন, কম সময়ে বেশি লাভবান হওয়ার আশায় প্রতারণায় পড়ার একটি বড় কারণ। আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখছি, প্রতারকরা তাদের টার্গেটকে লোভের ফাঁদে ফেলে। অনেক শিক্ষিত মানুষকেও আমরা বোকা হতে দেখছি। আরেকটি বিষয়, প্রতারণার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঢিলেমি। কারণ প্রতারণার প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে মামলা নেয়ার বিষয়ে আদালতের একটি নির্দেশনা রয়েছে। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ নিতে চায় না পুলিশ।
এছাড়া রাজনৈতিক ছত্রছায়া। জেকেজি ও রিজেন্ট প্রতারণার ক্ষেত্রে এমনটাই দেখা গেছে। প্রতারণা বন্ধে জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।
এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়
Leave a Reply