নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
মাহির সারোয়ার মেঘের কৈশোরটা অন্যরকম হতে পারতো। হয়তো বাবা, মায়ের ভালোবাসা, খুনসুটিতে মেতে থাকতো সে। কিন্তু না, মেঘের সেই ভাগ্য হয়ে ওঠেনি। ১১ বছর আগে আজকের এই দিনে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় দুর্বৃত্তদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক গোলাম মোস্তফা সারোয়ার ওরফে সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন নাহার রুনা ওরফে মেহেরুন রুনি। তাদের একমাত্র পুত্র মেঘের বয়স তখন ছিল মাত্র পাঁচ বছর।
মেঘ এখন ১৬ বছরের তরুণ। নানি ও মামার কাছে বড় হচ্ছিল সে। কিন্তু গত বছরের ৫ জানুয়ারি মারা যান মেঘের নানি নুরুন নাহার মির্জা। এখন অনেকটাই একা হয়ে পড়েছে মেঘ। মামার আদরে বেড়ে উঠলেও মন খারাপ হলে বা বাবা-মায়ের কথা মনে পড়লেই তাদের ছবি নিয়ে বসে থাকে। ছবিতে তাদের দেখে।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করছে র্যাব। এখন পর্যন্ত ৯৫ বার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তদন্ত শেষ হয়নি। সর্বশেষ গত ৪ জানুয়ারি মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু এদিন মামলার তদন্ত সংস্থা র্যাব প্রতিবেদন দাখিল করেনি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রট রশিদুল আলমের আদালত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পরবর্তী তারিখ ৫ মার্চ ধার্য করেন।
মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে রুনির ছোট ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, ‘আমাদের আর কি বলার আছে, বিচার চাওয়া ছাড়া। মামলার কোনো অগ্রগতি নেই, সব আগের মতই চলছে। আর মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গেও খুব একটা যোগাযোগ নেই। যাই হোক, বিচারটাই চাই, আর কিছুই চাওয়ার নেই।’
তিনি বলেন, ‘মেঘ এখনো তার মায়ের কথা বলে। আমরা প্রতি সপ্তাহে একবার করে কবর জিয়ারত করতে যাই। মেঘ এখন অনেক বড় হয়ে গেছে৷ মাঝে মধ্যে বাবা-মায়ের ছবি নিয়ে বসে থাকে দেখি ওকে। তাদের সে দেখে।’
সাগরের মা সালেহা মনির বলেন, ‘তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘটনাস্থলে এসে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেই ৪৮ ঘণ্টার ফলাফল ১১ বছর এসেও শূন্য রয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ১১ বছর ধরে চার্জশিট জমা দিতেই পারলেন না। একের পর এক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আসে আর যায়, কিন্তু চার্জশিট জমা হয় না। করোনাভাইরাসের আগে এক র্যাব কর্মকর্তা যোগাযোগ করলেও গত ২/৩ বছর ধরে আর কেউ যোগাযোগ করেননি।’
প্রধানমন্ত্রী দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রী চাইলে সব সম্ভব। উনি বললেই সব হবে।’
ছেলে সাগরের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘মায়ের মন তো সব সময় মনে হয় কালকেই আমার ছেলে সাগর চলে (মৃত্যু) গেলো। আমার ছেলে এভাবে মারা যাবে, চলে যাবে কল্পনাও করতে পারেনি। আবার মামলা যে এতো দেরি হবে এই সরকারে আমলেই সেটাই ভাবতে পারেনি। র্যাব তো সব জানে। প্রতিবেদন জমা দিলেই হয়। সোজা কথা আমার ছেলের খুনিকে দেখে যেতে চাই। তাদের শাস্তি হবে কিনা জানি না। তবে খুনিদের দেখে যেতে চাই, কেন আমার ছেলেকে খুন করলো, কিসের জন্য খুন করেছে। একটা মায়ের মনে আর কি আকুতি থাকতে পারবে। খুন হওয়ার ১২ বছর হতে চললো। কত খুনের বিচার হচ্ছে, ক্লুলেস কত মামলার বিচার হচ্ছে। ৩০/৩৫ বছর আগের মামলার বিচার হচ্ছে। কিন্তু সাগর-রুনির বেলায় এমন হচ্ছে কেন আমার বোধগম্য নয়।’
সালেহা মনির বলেন, ‘আমার ছেলেকে তো আর ফেরত পাবো না, এজন্য বিচার চাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমার একটাই কথা, ছেলে হত্যার বিচার চাই। আমার মৃত্যুর আগে হলেও দেখে যেতে চাই ছেলের হত্যাকারীদের বিচার। আমি এখন পর্যন্ত আমার ছেলের কবর জিয়ারত করতে যায়নি। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, যেদিন আমার ছেলের হত্যাকারীদের দেখবো, বিচার দেখে যেতে পারবো, ওইদিন কবর জিয়ারত করবো। এর আগে যদি আমার মৃত্যুও হয়, হোক। এরপরেও খুনিদের না দেখে আমি যাবো না।’
এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়
Leave a Reply