(কিছুদিন পরপর বিস্ফোরণের ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে মানুষ কতটা নিরাপদ আছে। অপরিকল্পিত ভবন গড়ে উঠেছে সেগুলোই এই শহরকে অগ্নিগর্ভ হওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে কিনা। বাসা বাড়ীর গ্যাস এবং কল-কারখানায় ব্যবহৃত গ্যাস দেখলে মনে হয় বিশাল কোন এটম বোম।)
শের ই গুল :
বিস্ফোরণের ঝুঁকিতে সম্পূর্ণ দেশ অন্যদিকে রাজধানী ঢাকা এখন অগ্নিগর্ভের মধ্যে রয়েছে। এ যেন অঘোষিত ‘মাইন’ সিস্টেমের বিবর্তনে ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। কিছুদিন পরপর বিস্ফোরণের ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে যে শহরটি আসলে কতটা নিরাপদ আছে কিংবা নতুন পুরনো মিলে যে হাজার হাজার পরিকল্পিত কিংবা অপরিকল্পিত ভবন গড়ে উঠেছে সেগুলোই এই শহরকে অগ্নিগর্ভ হওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে কিনা। গ্যাস সিলিন্ডার একটি বিপদজনক সমস্যা। অটো ভ্যানে, পিকআপে বিভিন্ন ভাবে গ্যাস পাম্প থেকে গ্যাস ভরে বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে।
এগুলো দেখলে মনে হয় বিশাল কোন এটম বোম। যেকোন মুহূর্তে বিস্ফোরিত হয়ে জ্বালিয়ে দিতে পারে পুরো এলাকা। যেতে পারে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। অন্যদিকে বাসা বাড়ীতে যে সকল গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার হচ্ছে এগুলো ব্যবহারের নেই কোন প্রশিক্ষণ কিংবা সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন। ফলে প্রায় প্রতিদিন শোনা যায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে পরিবারের কয়েকজন আগুনে পুড়ে মারা গেছে, আর কয়েকজনকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বার্ণ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অতপর টেলিভিশনের পর্দায় ঘন ঘন সংবাদটি প্রচার করা হয়। পরের দিনের পত্রিকার প্রথম পাতায় সংবাদটি স্থান পায়। চার সমস্যা প্রকট- বিশ্লেষকরা বলছেন অপরিকল্পিত ভবন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির অসংখ্য অবৈধ লাইন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো নগর জুড়ে, যার ফলে অনেক জায়গায় লিকেজ তৈরি হচ্ছে, যা থেকে হতে পারে মারাত্মক বিস্ফোরণ।
এছাড়া শহরের ভবনগুলোতে অভ্যন্তরীণ সংযোগ লাইনগুলোও নিয়মিত পরিচর্যা করা হয় না। ফলে প্রায়শই শর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে রাস্তার পাশের ভবনগুলো পর্যাপ্ত জায়গা না রাখায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন, যা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে পুরো ভবনকেই। আবার স্যুয়ারেজের লাইন ঠিক না থাকায় বা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম না করার কারণে গ্যাস জমে যাচ্ছে সেপটিক ট্যাংকে। এর বাইরে শীতের শেষের দিকে এসি বিস্ফোরণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো নিম্নমানের এসি ব্যবহার করা এবং গরমের সময়ে কয়েকমাস বন্ধ রেখে সার্ভিসিং না করিয়েই এসি ব্যবহার করা।
এছাড়া পুরনো ভবনগুলোর ভেতরে এক সঙ্গে অনেক এসি ব্যবহার করা হয় নির্ধারিত দূরত্ব না মেনেই। যেগুলোর কোন একটিতে গ্যাস লিকেজ হলে সবগুলোই বিস্ফোরিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। অবৈধ গ্যাসের লাইন এবং প্রায় প্রত্যেক শহর ও গ্রামের বাড়ীতে এখন গ্যাস সিলিন্ডার লক্ষ করা যাচ্ছে। যদিও সবাই গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করছে, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ গ্যাস সিলিন্ডার লক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবহারের নিয়ম।
ফলে দূর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। চারিদিকে শুধুই ঝুঁকি- বাস্তবতা হলো ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কত আছে তার কোনো হিসেব কারও কাছেই নেই। তবে ঢাকার আধুনিক এলাকাগুলোর অন্যতম বনানীতে একটি ভবনে আগুন লাগার পর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার কথা বলেছিলো রাজউক। পরে সংস্থাটি দাবি করেছিলো রাজধানী সহ দেশের অন্যান্য শহরের ভবন পর্যালোচনা করে জানা যায় প্রায় কয়েক লক্ষ ভবন রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ঢাকার সবচেয়ে বেশি ঘনবসতির এলাকা পুরনো ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে নানা উদ্যোগ নিলেও ভূমি মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া আসেনি।
এখন বিশ্লেষকরা বলছেন গ্যাস, পানি ও স্যুয়ারেজের লাইনে ত্রুটি এবং গ্যাস ও বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটই বড় ধরণের বিপর্যয় তৈরি করছে। অর্থাৎ প্লাম্বিং সমস্যাই এখন বড় যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠেছে এই নগরীতে। তাদের মতে এগুলো পর্যালোচনা করে সত্যিকার অর্থে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে সরকারের সহযোগী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে কারিগরি জরিপ দরকার। তবে এখন এই মুহূর্তে এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজী হয়নি রাজউক এবং সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কোন তদারকি নেই- এ প্রশ্নের কার্যত কোন জবাব নেই। কারণ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, রাজউক, সিটি কর্পোরেশনসহ কেউই কখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ জরিপের উদ্যোগই নেয়নি।
তবে ২০০৪ সালে পুরনো ঢাকায় একটি ভবন ধসে সতের জনের মৃত্যুর পর তখনকার সিটি কর্পোরেশন প্রায় পাঁচশো ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো। এরপর ২০১১ সালে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তর চার বছর মেয়াদি এক জরিপের পর ২০ বছরের বেশি বয়সী ইটের গাঁথুনিতে তৈরি প্রায় দু হাজার ভবনকে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছিলো। ২০১৫ সালে ভূমিকম্পে কয়েকটি ভবন হেলে পড়ার পর সরকার ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে বিশেষ রঙ দিয়ে চিহ্নিত করে তাতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন লেখা সাইনবোর্ড লাগানোর নির্দেশ দিয়েছিলো। তখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয় বলেছিলো যে ঢাকায় ৭২ হাজারের মতো ভবন ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। কিন্তু পরে এসবের কিছুই কার্যকরি হয়নি।
এগুলোর কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ জরিপ ছিলো না। তাই সত্যিকার অর্থেই বলার উপায় নেই যে ঢাকা শহরের প্রকৃত অবস্থা কি। রাজউক অবশ্য সবসময়ই বলে আসছে যে পুরো শহরে সমীক্ষা চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সব ভবনকে চিহ্নিত করার মতো জনবল তাদের নেই। “তৃতীয় পক্ষ দিয়ে দেখা উচিত যে ভবনগুলোর কি অবস্থা বা কোথায় কোন ভবনে কি ধরনের ত্রুটি আছে। আমরা যারা এগুলো নিয়ে কাজ করছি তারা জানি যে প্রতিটি ভবনেই কিছু না কিছু সমস্যা আছে।
বিস্ফোরণ ঘটেই চলেছে- ২০১৩ সালে রানা প্লাজার ঘটনাটি ঘটেছিলো ঢাকার কাছে সাভারে। তবে ঐ ঘটনায় হাজারের বেশি শ্রমিকের মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিক ক্রেতা গোষ্ঠীর চাপে গার্মেন্টস কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ উন্নত করার কাজ হয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু শহরের আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোর ক্ষেত্রে এ ধরণের কোনো চাপও আসেনি আবার কর্তৃপক্ষের দিক থেকেও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ২০১০ সালের জুনে ঢাকার নিমতলীতে বাসা বাড়িতে থাকা রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলো ১২৪ জন। অথচ পুরনো ঢাকায় রাসায়নিক গুদাম কত আছে তার কোনো পূর্ণাঙ্গ হিসাবও কারও কাছে নেই।
সরকারের মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের এক জরিপে একবার বলা হয়েছিলো যে রাসায়নিক ব্যবসার ১ হাজার ৯২৪ টি প্রতিষ্ঠান আছে। সম্প্রতি ২০২৩ সালে ঘটে গেল গুলিস্তানের বিস্ফোরণের ঘটনা সহ বেশ কয়েকটি আগুনে পোড়ার খবর। যদিও আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবি দাবি করেছিলো যে পুরনো ঢাকায় দাহ্য পদার্থের অন্তত পনের হাজার গুদাম আছে। ইন্সটিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বা আইপিডির নির্বাহী পরিচালক দৈনিক আমার প্রাণের বাংলাদেশকে বলেন, নিমতলীর ঘটনার তের বছরেও ওই এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ঢাকা অগ্নিগর্ভ হবে এমন একটা পর একটা ঘটনা ঘটছে কিন্তু একে কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না। “রাজউক, সিটি কর্পোরেশনসহ দায়িত্বশীলরা কি করেছে। আমরা শহরের বিভিন্ন জায়গায় নানা সময়ে কাজ করে দেখেছি প্রতিটি ভবনেই কিছু না কিছু ফল্ট আছে।
ফায়ার,ইলেক্ট্রিসিটি বা অবকাঠামোগত সমস্যা আছে। এখন বেশি দেখা যাচ্ছে প্লাম্বিং সমস্যা। অর্থাৎ পানি ও স্যুয়ারেজের লাইন কিংবা গ্যাস বা বিদ্যুতের সংযোগ সমস্যার কারণেই বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেক জায়গায় অবৈধ গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ লাইন চলছে কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই। আবার ইদানীংকালে বিস্ফোরণে যেসব ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানকার ক্ষয়ক্ষতি শুধু ভবনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং রাস্তার যানবাহনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এসব প্রমাণ করে যে ভবনটি রাস্তা থেকে যত দূরে যেভাবে নির্মিত হবার কথা তা হয়নি। এগুলো দেখার দায়িত্ব আসলে কার?” নগরের মূল বিষয় হলো ব্যবস্থাপনা। আর এই ব্যবস্থাপনার অংশ হলো নিয়মিত পরিদর্শন করে দেখা যে গ্যাস লিকেজ, স্যুয়ারেজ, এসি – কিন্তু ঠিক আছে কি-না। অথচ রাজউক এবং কলকারখানা পরিদর্শন পরিদপ্তরের আইনে পরিদর্শনের বিধান থাকলেও এই ব্যবস্থাপনা একেবারেই শূন্য “অবৈধ গ্যাস লাইন যে আছে সেটা তো সবাই জানে। কিন্তু কেউ তো রাষ্ট্রকে জাগাতে পারেনি।
২০১০ সালে নিমতলীর তের বছরেও রাসায়নিক গুদাম সরানো যায়নি। ভবন দুর্ঘটনায় বাইরের রাস্তায় পথচারী মরছে। পরিকল্পনা ঘাটতি আছে কি-না। কেউ তো দেখছে না,” ঢাকা বেশি বিপজ্জনক হয়েছে ভূমির মিশ্র ব্যবহারের কারণে আর এটি আরও সংকটাপন্ন হচ্ছে আধুনিক ভবন বানানোর নামে আলো বাতাস প্রবেশের সুযোগ না রেখে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ভবন নির্মাণের কারণে। “পুরো নগরী বিপজ্জনক মিশ্র ব্যবহারের কারখানা। একই ভবনে রেস্তোরা, আবাসিক কিংবা ক্যামিকেল সামগ্রীর দোকান। সব মিলিয়েই তাই বলতে পারেন যে ঢাকা আসলেই অগ্নিগর্ভ অবস্থায় আছে।
এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়
Leave a Reply