(দেশব্যাপী অপরাধ জগতের ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং। খুব শীঘ্রই সারাদেশে কিশোর গ্যাং সদস্য গ্রেফতারের জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষ অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের ডিজিটাইলড তালিকা তৈরির কাজ চলছে।)
শের ই গুল :
কিশোর গ্যাংয়ের লিডাররা এখন নতুন এক পথ বেছে নিয়েছে। কিছু টাকা খরচ করে প্রথমে হয়ে যায় কোন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া কিংবা কোন পত্রিকার সাংবাদিক। অথবা অভাবী সাংবাদিকদের কিছু টাকা পয়সা দিয়ে লোভে ফেলে তাদেরকে নিয়ে একটি গ্রুপের মতো তৈরি করে বিভিন্ন বাসাবাড়ী কিংবা অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে তাদেরকে ক্যামেরার সামনে জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। এদের অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজির মামলা হলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিন নিয়ে অথবা কয়েক মাস জেল খেটে আবার নতুন করে শুরু করে অপকর্ম।
এসব কিশোরগ্যাংয়ের সদস্যরা নিজ নিজ এলাকা ভিত্তিক বিভিন্ন অপরাধীদেরকে সুযোগ করে দেয় অপরাধ করার জন্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাদক স্পট নিয়ন্ত্রণ, অসামাজিক কার্যকলাপে নিয়োজিত, টু নাইনটি হাউজ, আবাসিক হোটেল, চোরাই তেলের স্পট, স্পা এবং অনুমোদনহীন বার সহ বিভিন্ন অপরাধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের নিকট থেকে এরা সাপ্তাহিক এবং মাসিক হারে চাঁদা গ্রহণ করে তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। তাদের এসব বিষয় নিয়ে কোন প্রকৃত সাংবাদিক ন্যায্য কথা লিখলে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করে কিংবা সুযোগ বুঝে মারধর করে আহত করে এসব কিশোরগ্যাং সদস্যরা। এদের সাথে থানার কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশ সহ রয়েছে সাংবাদিক নেতা টাইপের কিছু অপসাংবাদিকদের সাথে আতাত। অপরাধের সবচেয়ে বড় ভয়ঙ্কর রূপ এখন কিশোর গ্যাং।
রাজধানীতে এখন ১৫০ থেকে ২০০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা এলাকাতেই এরকম বহু গ্যাংয়ের বাড়-বাড়ন্ত। মারামারি, ছিনতাই, মাদকের কারবার এমনকি হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা। উত্তরার বিভিন্ন স্পট যেমন- সাঙ্গামের মোড়, ৭ নং ব্রীজ সংলগ্ন, ৫ নং সেক্টরের বিভিন্ন রাস্তার মোড়, ময়লার মোড়, ১৫ নং সেক্টর, খালপাড়, বিএনএস টাওয়ারের পিছনে সহ সম্পূর্ণ উত্তরার বিভিন্ন কফি হাউজ সহ এরা মটরবাইক নিয়ে এক এক সময় এক এক জায়গায় অবস্থান করে। উত্তরা ছাড়াও মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, বাড্ডা, পুরান ঢাকা সহ রাজধানীর প্রায় এলাকায় এক শ্রেণির উঠতি বয়সির উশৃঙ্খল ছেলেরা গড়ে তুলেছে কিশোর গ্যাং।
এদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক ব্যক্তি সহ ব্যবসায়ী ও কথিত চাঁদাবাজ সাংবাদিক নেতারা। দেশব্যাপী অপরাধ জগতের ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং। খুব শীঘ্রই সারাদেশে কিশোর গ্যাং সদস্য গ্রেফতারের জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষ অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের ডিজিটাইলড তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ছোট ছোট অপরাধ থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ড, ইভটিজিং, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, মাদকাসক্তি, মাদক, আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কিত গুরুতর অপরাধে জড়িড়ে পড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কিশোর গ্যাং সদস্যদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার ঘটনাটি আশঙ্কাজনক।
হুমকির মুখে পড়ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। প্রতিবেদনে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বিষয়ে ১২ দফা সুপারিশ করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায় সারাদেশের ৬৪ জেলা, উপজেলা ও মহানগর এলাকায় অন্তত ৫ শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয়। কেবল রাজধানী ঢাকাতেই সক্রিয় ১৫০-২০০ কিশোর গ্যাং। সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার হবে। এর মধ্যে রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা হবে কয়েক হাজার। গত তিন বছরে এই গ্যাংয়ের হাতে সারাদেশে খুন হয়েছে অন্তত শ খানেক।
এসব খুনের ঘটনায় আসামি করা হয়েছে ৫ শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে। আলোচ্য তিন বছরে ২ শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যকে সাজা দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। সাজাপ্রাপ্ত ও গ্রেফতার হওয়া কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের রাখা হয়েছে তিনটি সংশোধনাগারে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশের ৬৪ জেলা, থানা, বিভাগ ও মেট্রোপলিটন এলাকায় গড়ে ওঠা অন্তত ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার কিশোর গ্যাংয়ের দাপটে আতঙ্কে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে গ্রাম-গঞ্জ, পাড়া-মহল্লা, হাট-বাজার, শহর-বন্দর সর্বত্র। কেবল রাজধানী ঢাকার ৫০ থানা এলাকাতেই দুইশতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের কিশোর গ্যাংয়ের নামগুলো শুনলেই মানুষজনের ভয়ে কাঁপন দিয়ে লোম খাড়া হয়ে আতঙ্কের শিহরণ জাগায়।
রাজধানী ঢাকাতে যেসব কিশোর গ্যাংয়ের নাম রয়েছে তার মধ্যে এক সময় পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার ও নাইন এমএম বয়েজ, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্যাক রোজ, রনো, কেনাইন, ফিফটিন গ্যাং, পোঁটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, থ্রি গাল গ্যাং, লাগবি নাকি, মাঈনুদ্দিন গ্রুপ, ইকবাল গ্রুপ, বিহারি রাসেল গ্যাং, বিচ্ছু বাহিনী, পিচ্চি বাবু, সাইফুলের গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, বাবু রাজন গ্যাং, রিপন গ্যাং, মোবারক গ্যাং, নয়ন গ্যাং, তালাচাবি গ্যাং, নাইন এম এম, একে ৪৭ ও ফাইভ স্টার গ্রুপ, স্টার বন্ড গ্রুপ, মোল্লা রাব্বির গ্রুপ, গ্রুপ টোয়েন্টিফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, কোপায়ইয়া দে, শাহীন-রিপন গ্যাং, নাজিম উদ্দিন গ্যাং, শান্ত গ্যাং, মেহেদী গ্যাং, সোলেমান গ্যাং, রাসেল ও উজ্জ্বল গ্যাং, বাংলা ও লাভলেট গ্যাং, জুম্মন গ্যাং, চান-জাদু, ডেভিল কিং ফুল পার্টি, ভলিয়ম টু, ভাণ্ডারি গ্যাং, টিকটক গ্যাং, পোঁটলা সিফাত গ্যাং যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। কেবল রাজধানীতে ৫০টির বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে। প্রতিটি গ্যাংয়ে সদস্য রয়েছে ১৫ থেকে ২০ জন করে। এই গ্যাংগুলো উত্তরা, তুরাগ, খিলগাঁও, দক্ষিণ খান, টঙ্গী, সূত্রাপুর, ডেমরা, সবুজবাগ, খিলক্ষেত, কোতোয়ালি, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমণ্ডি আগারগাঁও ও হাতিরঝিলে সক্রিয়।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়া থেকে শুরু করে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণকারীদের ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। দেশের নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হচ্ছে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমের বিরোধ, মাদক খুনোখুনিসহ নানা অপরাধে কিশোর-তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ব্যবসা ও দখলবাজিতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অধিকাংশ কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার পেছনে রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মদদ দেয়ার অভিযোগ আছে। ‘হিরোইজম’ প্রকাশ করতেও পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়া কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধানে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ‘বড় ভাই’রা। ঢাকায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের খুনোখুনিতে কিশোর ও তরুণদের ব্যবহার করার ঘটনাও ঘটেছে। র্যাব-পুলিশের অভিযানে এ পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের কয়েকশ’ সদস্য গ্রেফতার হলেও এখনও সক্রিয় আছে অনেক। সাধারণ মানুষ বলছে, ‘অনেক সময় রাতে চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। রাস্তায় মারধর করে। অনেক সময় ছিনতাইয়ে বাধা দেয়ায় ছুরিকাঘাত করে।
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি পুলিশকে এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিশোর গ্যাং গ্রুপগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাইনস্টার গ্রুপ, যার নেতা সিয়াম। টিএমসি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছে মামুন আর শিশির। পাকুরিয়ার সোলেমান-মোবারক গ্রুপও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিশোর গ্যাংয়ের এক সদস্য জানায়, ‘এমনও আছে, মানুষ বিভিন্ন জায়গায় মামলাও দিয়েছে। কখনো আবার গ্রেফতারও হচ্ছে। বড় কোন ঘটনা ঘটালে এলাকা ছেড়ে যায় অনেকে। পরে পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে পুনরায় ফিরে আসে।’ কথিত বড় ভাইদের মদদেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গ্যাংয়ের কিশোররা। জানতে চাইলে ওই কিশোর বলেন, ‘অনেক সময় কোন সদস্য ধরা পড়লে বাকিরা বড়ভাইদের জানায়।
তিনি আবার সব জায়গায় কথা বলে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করেন।’ পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আব্দুল্লাহ আল মামুন দায়িত্ব নেয়ার পর পরই সারাদেশে পুলিশের সব ইউনিটকে কিশোর গ্যাং সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বিশেষ ফাইল তৈরির করার নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক সারাদেশে কিশোর গ্যাং শনাক্তকরণ এবং গ্যাং সদস্যদের গ্রেফতার করতে ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত আছে এবং সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরির বিষয়টিও অব্যাহত আছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার অপরাধ পরিস্থিতি সম্পর্কিত মাসিক পর্যালোচনা বৈঠকে রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন। ডিএমপির অপরাধ বিভাগকে সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি দেখতে বলেছেন তিনি। পাশাপাশি, তিনি পুলিশ সদস্যদের বলেছেন, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের চিহ্নিত ও নজরদারিতে রাখতে। ডিএমপি কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলাম গ্যাং কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় নগরীর বিভিন্ন সড়কে অস্থায়ী চেকপয়েন্ট বসানোর ওপরও তাগিদ দিয়েছেন।
এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়
Leave a Reply