রফিকুল ইসলাম :
চোরে শুনেনা ধর্মের কাহিনী। মাথায় পাগড়ি, মুখে দাঁড়ি, হাতে থাকে লাঠি, তার কাছে আছে জ¦ীন, মাঝে মাঝে নাকি আল্লাহর সাথেও কথা কয়! এক সময় ভারত-বার্মা-বাংলাদেশ সব শাসন করবে এই নূরুল হক এমনটাই দাবী তার। তিনি সাধন করে হাসিল করেছে এক বিশাল ম্যাগনেটিক পিলার। যার দাম নাকি বাংলাদেশের সমান। এই কথা বলে এই প্রতারক নূরুল হক একটি প্রতারক চক্র তৈরি করে সারা বাংলাদেশ। সুকৌশলে বিভিন্ন তালবাহনা দেখিয়ে সদস্য সংগ্রহ করে তাদেরকে কোটি কোটি টাকার প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন কৌশলে প্রায় ৪ শত কোটি টাকার উপরে।
ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে প্রতারণার কয়েকটি মামলা হলেও মূল ঘটনা রয়েছে অধরা। এই চক্রের অন্যতম প্রধান সদস্য নূরুল হক (ভন্ড দাদা ভাই), তার সহযোগী এনায়েত উল্লাহ, মনিরুল্লাহ, আজাদ, মেহেরাব হোসেন মুগ্ধ, মনি আক্তার, রঞ্জু, সোহাগ, জালাল আহমেদ, ইজাম্মেল, এরশাদ, সুমন। এ বিষয় নিয়ে ভুক্তভোগী আবু বকর সিদ্দিক ২০২১ সালে তুরাগ থানায় একটি মামলা করে। মামলা নং- ১৭, তাং- ২৫-০৫-২০২১ ইং। অনুসন্ধান করে জানা যায়, তার গ্রামের চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে গণ্যমান্য সবাই জানে নুরুল হক প্রথম সারির এক প্রতারক। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশলে মিথ্যা নাটক করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই তার কাজ। বিগত প্রায় ১০-১২ বছর যাবৎ হাজার হাজার মানুষকে বোকা বানিয়ে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। মোঃ নুরুল হক ওরফে দাদা সে নিজেকে একজন আধ্যাত্মিক পীর বলে দাবী করে।
সবাইকে বলে সে স্বঘোষিত ঈমাম মাহাদি, তার অনেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা এবং দেশ বিদেশে তার যোগাযোগ আছে বলে সবাইকে বলে বেড়ায়। আগাম কর্পোরেশন, আগাম বহুমুখী ফার্ম, পিটি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এম এম এন্টারপ্রাইজ নামীয় বহু কোম্পানীর তিনি মালিক, এগুলোর কোন ভিত্তি নেই। তার কোম্পানী গুলোর অধীনে বাবু নগর প্রকল্প, গাভী পালন প্রকল্প, এম এম মৎস্য খামার, হিলফুল ফুজুল নূরানী ও হাফেজিয়া মাদ্রাসা, ভি-১, ভি-২ থেকে ভি-১০০, ভুলস এরকম শতাধিক প্রকল্প এবং এই প্রকল্প সমূহের অধীনে ডিম প্রোগ্রাম, পিন কোড, জোন, ক্যাশ জোন, হাইকমান্ড, আরোও শত শত মনগড়া প্রোগ্রাম বানিয়ে সবাইকে জানায়, বিভিন্ন প্রজেক্টরের মাধ্যমে তিনি মানুষকে আর্থিক সহায়তা করে সাবলম্বী করার বিভিন্ন প্রকার আশ্বাস দেন। তার এই কাজে সহযোগীতা করে বিশাল একটি কু-চক্রী মহল। তাদের মধ্যে অন্যতম এনায়েত উল্লাহ।
তিনি জানান, অচিরেই মালয়েশিয়া, বার্মা, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এই পাঁচটি দেশকে একত্র করে অচিরেই শাসন করবেন। সে বলে বাংলাদেশের নারী নেতৃত্ব শেষ করে দিয়ে বাংলাদেশে নতুন সরকার গঠন করবে। তার কাছে পিলার আছে দাবী করে বাংলাদেশের বিভিন্ন থানা জেলা থেকে বিশ হাজারের অধিক সদস্য তৈরি করে তাদের নিকট থেকে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। নুরুল হক কোন মামলার ঝামেলায় পড়লে সেগুলো মোকাবেলা করার জন্য আলাদা কয়েক কোটি টাকার একটি ফান্ড করা হয়েছে।
কেউ মামলা করলে তার বিরুদ্ধে তার সহচররা মামলা দিবে বলে ভয় দেখিয়ে অনেক বিদ্রোহীকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করে এই কু-চক্রী মহলের গোষ্ঠী। নুরুল হকের মামলার বিষয়টি দেখে আজাদ, জালাল আহমেদ, মনিরুল্লাহ এবং এনায়েত উল্লাহ। বাকী কাজে ইজাম্মেল, এরশাদ, রঞ্জু, সোহাগ, তাকে সহযোগীতা করে। বিভিন্ন জায়গা থেকে এসব সহচররা মক্কেল ধরে এনে কোটি কোটি টাকা দিবে বলে নুরুল হকের সাথে স্ট্যাম্পে ডিড করে কৌশলে হাতিয়ে নেয় লক্ষ লক্ষ টাকা। যারা মক্কেল আনবে টাকা নুরুল হককে দিবে সেখান থেকে একটি ভাগ আবার দেওয়া হয় সহযোগীকে।
ভন্ড নুরুল হককে বিভিন্ন জায়গায় স্থান পরিবর্তন করার জন্য রয়েছে তার বিশ্বস্ত ড্রাইভার সুমন। সম্প্রতি সুমনের স্ত্রী অন্য কারও সাথে চলে গেলে নুরুল হকের শালার মেয়ে বিয়ে দেয় সুমনের সাথে। অন্যদিকে নুরুল হকের স্ত্রী মনি আক্তার সবাইকে আপ্যায়ন করে এবং সবাইকে বুঝায় বিশাল কাজ সবাই ধৈর্য ধরেন। আপনাদের দাদা অল্পদিনের মধ্যেই সবাইকে কোটিপতি করে দিবে। নূরুল হকের ছেলে মেহেরাব হোসেন মুগ্ধ’র নামে কেনা হয়েছে অনেক সম্পত্তি। নুরুল হকের স্ত্রীর রয়েছে দুইশত ভরির উপর স্বর্ণ।
কেনা হয়েছে নামে বেনামে শত শত বিঘা জমি। দুর্নীতি দমন কমিশন ভন্ড নুরুল হকের সম্পত্তির হিসাব নিলে বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল। নুরুল হকের গ্রামের পুরান বাড়ীর আশেপাশে বিভিন্ন স্থানে ম্যাগনেটিক পিলারের মতো তৈরি করে পুতে রেখেছে মাটির নিচে। যেভাবে প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয় টাকা।
তার একটি হিসাব- প্রথমত সদস্য- ৬০০০×২০০০০ = ১২০,০০০০০/-, প্রজেক্ট-৬০০০×২০০০০ = ১২০,০০০০০/-, এবিএফ-১০,০০০×২০০০০ = ২০০,০০০০০০/-, আইয়াম- ৫৩০০০×২০০০০ = ১০,৬০,০০০০০০/-, হাই কমান্ড- ৮০,০০০×২০০০০ = ৬০০,০০০০০০/-, ভি-১-৩০০০০×২০০০০ = ৬০,০০০০০০/-, ভি-২- ৩০,০০০×২০,০০০ = ৬০,০০০০০০/-, ভি-৩- ৩০,০০০×২০,০০০ = ৬০,০০০০০০/-, ভি-৪- ৫০০০×২০০০০ = ১০০,০০০,০০০/-, ভি-৫- ৫০০০×২০০০০ = ১০০,০০০,০০০/-, ভি-৬- ৫০০০×২০০০০ = ১০০,০০০,০০০/-, ভি-৭- ৫০০০×২০০০০ = ১০০,০০০,০০০/-, ভি-৮- ৫০০০×২০০০০ = ১০০,০০০,০০০/-, ভি-৯- ৫০০০×২০০০০ = ১০০,০০০,০০০/-, ভি-১০- ৫০০০×২০০০০ = ১০০,০০০,০০০/-, জেলা প্রতিনিধি- ৩০০০০×২০০০০ = ৬০০,০০০,০০০/-, বিভাগীয় প্রধান- ৬০০০০০০×২০,০০০০৮ = ৪৮০০০০০/-, প্রজেক্ট প্রোফাইল এ্যাকাউন্ট- ৫০০০০×২০০০০ = ১০০০,০০০,০০০/-, সর্বমোট- ৪১৪৮৮০০০০০/- এভাবে (চারশত চৌদ্দ কোটি আটাশি লক্ষ) টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন মানুষের নিকট থেকে।
বর্তমান সময়ে চলছে বিদেশী লাল পাসপোর্ট এবং দামী গাড়ী ও গুলশাসেন বাড়ী দেওয়ার নামে এবং বিভাগীয় প্রধানের নামে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে জন প্রতি ৬ লক্ষ টাকা করে। শেরপুর শ্রীবরদীর একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্ম নূরুল হকের। দৈনিক আমার প্রাণের বাংলাদেশ অনুসন্ধান করলে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল, গ্রামের মানুষরা জানান, নূরুল হক একেক সময় একেক অভিনয় করে ছদ্মবেশ সেজে প্রতারণা করে মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিতো টাকা।
আবার কিছুদিন থাকতো নিরুদ্দেশ। আবার হঠাৎ করে আবির্ভাব ঘটতো তার। সম্পূর্ণ গ্রামের মানুষ জানে সে জন্মগতভাবে প্রতারক হিসেবে পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠেছে। তার শরীরের আপদ মস্তক প্রতারণার বিষে ভরা। একের পর এক মিথ্যা কথা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি তার নিত্য দিনের পেশা। আজ কাজ হয়ে যাবে, কাল কাজ হয়ে যাবে, আগামী মাসে হবে ইত্যাদি তালবাহনা করে বিভিন্ন ফরম কাগজ, হাতে দিয়ে জানায়, এই কাগজ জমা দেওয়া শেষ হলেই মূল কাজ শুরু। এভাবেই অভিনব কায়দায় হাতিয়ে নেয় সকল সদস্য ও কর্মকর্তাদের কাছ থেকে টাকা।
প্রতারক নূরুল হকের অবাস্তব পিলারের গল্পে যারা নিজেদেরকে সোপর্দ করেছেন নূরুল হকের হাতে টাকা তুলে দিয়েছেন এর সংখ্যা প্রায় ২০-৩০ হাজার হবে। যে যত বেশি টাকা দিয়েছে, পদোন্নতি তার বড়। এভাবেই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০-৩০ হাজার পরিবারকে করেছে নিঃস্ব। কেউ কেউ জমি বিক্রি করে মোটা অংকে সুদ নিয়ে অধিক লাভবান হওয়ার প্রত্যাশায় নূরুল হকের হাতে তুলে দিয়েছে তাদের জীবনের শেষ সম্বল টুকু। প্রতারক নূরুল হকের সংস্পর্শে এসে অনেকেই হারিয়েছে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য, হারিয়েছে তাদের চাকুরী। কারণ নূরুল হক তাদেরকে বলেছে ব্যবসা করে চাকুরী করে কি হবে, আমিই তো তোমাদেরকে কোটি কোটি টাকা দিবো।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে করেছে অফিস, প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছে এম এম এন্টারপ্রাইজ, পিটি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিঃ, সরল পথ সমবায় সমিতি, এনজিও সহ বিভিন্ন বাহারী নাম দিয়ে করেছে প্রতারণা ছক। কখনো শেরপুর অফিস, কখনো ময়মনসিংহ, কখনো গাজীপুর মালেকের বাড়ী, কখনো রাজধানীর গুলশান, উত্তরা ও যাত্রাবাড়ী সহ বিভিন্ন স্থানে অফিস করে চাকচিক্য ডেকারেশন করে তার সদস্যদেরকে বুঝিয়েছে বায়ার আসবে আমার মালের দাম ফাইনাল হয়ে গেছে, সবার এ্যাকাউন্টে চলে যাবে টাকা। আবার করোনা মহামারীর সময় সবাইকে বলেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে চুক্তি হয়েছে সেনা বাহিনীর গাড়ীতে আপনাদের টাকা পৌঁছে দিবে সবার বাড়ী বাড়ী।
ভুক্তভোগী একজন জানান, প্রথমে বলেছিল সাদা চামড়ার একজন লোক আসবে তিনি আমাদের সব টাকা বুঝিয়ে দিবেন। এরপর আবার বলেছে কালো চামড়ার একজন লোক আসবে তিনিই সবার টাকা বুঝিয়ে দিবেন।
এই সাইটের কোন লেখা কপি পেস্ট করা আইনত দন্ডনীয়
Leave a Reply